বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬, ০৬:১০:৫৮

অর্থ ফেরত দেবেন কিম

অর্থ ফেরত দেবেন কিম

নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ধরা হচ্ছিল ফিলিপাইনের চীনা বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী কাম সিন অং ওরফে কিম অং’কে। সেই কিম অং মঙ্গলবার দেশটির ব্ল–-রিবন সিনেট কমিটির শুনানিতে বক্তব্য দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘৮০ কোটি ১০ লাখ ডলার এ দেশে এনেছে দুই বিদেশী। ক্যাসিনো ব্যবসা খোলার নামে এ অর্থ আনেন তারা। এরা হচ্ছেন- বেইজিংয়ের শুয়া হুয়া গাও এবং ম্যাকাওয়ের ডিং জিজে।’

চুরিতে নিজের জড়িত থাকার কথা পুরোদস্তুর অস্বীকার করেছেন কিম অং। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ওই টাকার কিছু অংশ তার সোলায়ার ক্যাসিনোর হিসাবে রয়েছে। এর পরিমাণ ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ অর্থ ফেরত দিতে তার আপত্তি নেই। অং আরও বলেন, চুরিতে যুক্ত দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার শাখা ম্যানেজার মায়া সান্তোস দেগুইতো। নিজ গাড়িতে ২০ লাখ পেসো এদের একজনের কাছে পৌঁছেও দিয়েছিলেন তিনি। কিম অং আরও দাবি করেন, অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠান ফিলরেমে এখনও চুরির এক কোটি ৭০ ডলার রয়েছে। আর মিডাস হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনোতে রয়েছে আরও ৮ লাখ ৬৩ হাজার ডলার।

শুনানিতে এদিন বক্তব্য দেন সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোর প্রতিনিধি সিলভেরিও বেনি তানও। তিনি তার ক্যাসিনোর মাধ্যমে ২ কোটি ৮৭ লাখ ডলার জুয়াড়িদের কাছে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সন্দেহজনক মনে হওয়ায় এর ১০ কোটি ৮৬ লাখ পেসো (প্রায় ২৩ লাখ ৫১ হাজার ডলার) তার ক্যাসিনো জব্দ করে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় সে অর্থ ফেরত দেবেন তিনি। যদি সব অর্থই মিলে তবে প্রায় ৭৮ লাখ ডলার ফেরত আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিন শুনানিতে হাজির হন আরসিবিসি প্রতিনিধিও। তিনি জানান, চুরির অর্থ জানার পরও আইনি ক্ষমতা না থাকার কারণে ওই অর্থ আটকানোর সামর্থ্য তাদের ছিল না। তবে এদিন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে শুনানিতে যাননি মায়া সান্তোস দেগুইতো। আর ব্লু-রিবন সিনেট কমিটির প্রধান তেওফিস্তো গুংগোনা বলেন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ৮৫ কোটি ডলার অর্থ চুরি ঠেকিয়েছে। কিম অং ও ওয়েকিং হুর বিরুদ্ধে এদিন সমন জারি করেছে দেশটির বিচার বিভাগ।

ফিলিপাইনের গণমাধ্যম জিএমএ নিউজ, ইনকোয়ারার, র‌্যাপলার, এবিএস-সিবিএন এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এএফপি, রয়টার্স ও সিএনএনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কিম অংয়ের ভাষ্য : চীনা বংশোদ্ভূত এ ব্যবসায়ী বলেন, গাও প্রায়ই ফিলিপাইনে যাওয়া-আসা করেন এবং গত আট বছর ধরে জুয়ার মক্কেল (জাংকেট এজেন্ট) এনে দেন। এ মহলে পরিচিতি রয়েছে তার। ম্যাকাওয়ের ব্যবসায়ী ডিংকেও তিনিই তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের পাসপোর্টের অনুলিপিও সিনেট কমিটিতে দিয়েছেন তিনি।

অং বলেন, গাও একবার সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোতে এক সপ্তাহের মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন ফিলিপিনো পেসো হেরে ওই অর্থ তার কাছ থেকে ধার করেছিলেন।

জাংকেট অপারেটর হিসেবে জুয়াড়িদের গ্যারান্টার ও তাদের থাকা, ভ্রমণসহ নানা ধরনের সেবা প্রদান করেন কিম অং। চুরি হওয়া টাকার মধ্যে এক বিলিয়ন পেসো তার কোম্পানি ইস্টার হাওয়াই লেইজার কোম্পানি লিমিটেডে গিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন পেসো ধার পরিশোধ হিসেবে দিয়েছিলেন গাও। বাকি ৫৫০ মিলিয়ন চিপস-এ রূপান্তর করে তার ক্যাসিনোয় খেলা হয়েছিল এবং পুরো টাকাটা হেরে গিয়েছিল। ধারের অর্থ হিসেবে যে ৪৫০ মিলিয়ন পেসো পেয়েছিলেন সেটা অং ফেরত দিতে রাজি।

ঘটনার বিবরণে কিম অং বলেন, গাও তার কাছ থেকে যখন অর্থ ধার করেছিলেন সে সময় রিজাল আরসিবিসি জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো তাকে ওই শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খোলার অনুরোধ করেন। তখন গাওকে তার কাছে পাঠান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে সঞ্চিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ থেকে হাতিয়ে নেয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার আরসিবিসির এই শাখা দিয়েই ফিলিপাইনে ঢুকেছিল।

অং বলেন, ২০১৫ সালের মে-তে কোনো এক সময় মিডাস হোটেলে তার অফিসে গাও ও তার সঙ্গে দেগিতোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় গাও একটি ডলার অ্যাকাউন্ট খুলতে চাইছিলেন। তবে দেগিতো তখন বলেন কোনো একটি কোম্পানির অ্যাকাউন্টের জন্য তাদের পাঁচজনের অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এর ২ থেকে ৩ দিনের মাথায় পাঁচটি ডলার অ্যাকাউন্টের জন্য দেগিতো তাকে ফোন করে আড়াই হাজার ডলার চান।

এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি গাও তাকে বলেন যে, তিনি ও ডিং ম্যাকাওয়ে তাদের ক্যাসিনো বন্ধ করে ম্যানিলায় বিনিয়োগ করতে চাইছেন। পরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি সোলাইরি হোটেলে গাও ও ডিং এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তারা দু’জন তাকে বলেন দেগিতোকে ফোন করে ওই পাঁচ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘চেক’ করতে বলেন।

অং বলেন, কয়েক দফা ফোন করার পর দেগিতো দুপুর ১টার দিকে ফোন করে তাদের জানান, মোট ৮১ মিলিয়ন ডলার তাদের অ্যাকাউন্টে আসতে শুরু করেছে। এ সময় দেগিতোকে ওই হোটেলে টাকা নিয়ে আসতে অনুরোধ করেন তিনি। দেগিতোর অনুরোধে ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফিলরেম সার্ভিস কর্পোরেশনের মিকাইল বাউতিস্তা ৮০ মিলিয়ন পেসো নিয়ে আসেন। পরে দেগিতো আরও ২০ মিলিয়ন পেসো নিয়ে আসেন।

এরপরেও বাউতিস্তার বাড়ি থেকে তিনি ৩০০ মিলিয়ন পেসো এবং ৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেন। এরমধ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি ১০০ মিলিয়ন পেসো ও তিন মিলিয়ন ডলার, ১০ ফেব্রুয়ারি ১০০ মিলিয়ন পেসো ও দুই মিলিয়ন ডলার এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি বাকি ১০০ মিলিয়ন পেসো সংগ্রহ করেন বলে জানান তিনি। এই অর্থ লেনদেনে ব্যবহৃত পাঁচটি অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে কাগজপত্র জালিয়াতির জন্য দেগিতোকে দায়ী করেন অং। হাতিয়ে নেয়া মোট ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৬৩ মিলিয়ন ডলারের মতো মিডাস ও সোলাইরি ক্যাসিনোয় গেছে বলে জানান তিনি।

দেগিতোর দেয়া বক্তব্যের সূত্র ধরেই এ জালিয়াতিতে কিম অংয়ের নাম আসে। সিনেট কমিটির সামনে আসার আগে স্থানীয় গণমাধ্যমের সামনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন তিনি। ব্লু-রিবন কমিটির সদস্য সিনেটর সের্গিও ওসমেনাকে উদ্ধৃত করে ইনকোয়ারার এর আগে জানিয়েছিল, কিম অংই ওই ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো দেগিতোকে খুলতে বলেছিলেন। ফিলরেমেও ডলার ভাঙানোর নির্দেশও তিনিই দিয়েছিলেন।

১৫ বছর আগেও কিম অং একবার সিনেট ব্লু-রিবন কমিটির শুনানির মুখোমুখি হন। অবৈধ মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সে সময় ৩৯ বছর বয়সী অংকে ডাকা হয়েছিল। এক সিনেটরের সঙ্গে মাদক চোরাচালানিদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে।

১০ বছর বয়সে চীন থেকে ফিলিপিন্সে আসেন অং। কলেজের ছাত্র থাকাকালে লেখাপড়া বাদ দিয়ে স্থানীয় একটি সিগারেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির কাজে যোগ দেন। পরে নিজেই একজন ব্যবসায়ী বনে যান এবং পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোতে ‘জাংকেট অপারেটর’ ওয়েইকাংক হু মাধ্যমে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার হাতবদল হয় বলে সিনেট কমিটির শুনানিতে উঠে এসেছে।

অর্থ স্থানান্তর ঠেকানোর আইনি ক্ষমতা ছিল না -রিজাল ব্যাংক : শুনানিতে সিনেটর সার্জিও ওসমেনা রিজাল ব্যাংকের আইনি বিভাগের প্রধান মেকেল ফার্নান্দেজ-এস্তাভিলোর কাছে জানতে চান, অর্থ চুরি হয়ে যাচ্ছে- এটা বুঝতে পারার পরও কি অর্থ স্থানান্তর বন্ধ করতে পারত না ব্যাংক?

উত্তরে এস্তাভিলো বলেন, অর্থ স্থানান্তর জব্দ করার অনুরোধ না জানানো হলে এ ব্যাপারে ব্যাংকের কিছু করার নেই। ব্যাংক শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে পারে এবং সন্দেহভাজন লেনদেনের বিষয়টি নথিভুক্ত করতে পারে। ওই অর্থ জব্দ করার কোনো আইনি এখতিয়ার ব্যাংকের নেই। আর আইন অনুযায়ী, চুরি যাচ্ছে বুঝতে পারার পরও ওই অর্থ নিজেদের কাছে ধরে রাখার কোনো বিধান নেই।

সিনেটর ওসমেনা তখন বলেন, তিনি অন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন যে অর্থ চুরি যাচ্ছে, এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থ স্থানান্তর একতরফাভাবে বন্ধ করে দিতে পারেন তারা। তখন রিজাল ব্যাংকের এস্তাভিলো জোরালভাবে বলেন, ‘না, আমরা বন্ধ করতে পারি না। আইন আমাদের এটা করার অনুমোদন দেয় না।’ তিনি বলেন, ‘অর্থ জমাদাতার লিখিত সম্মতি পেলে আমরা গোপন তথ্য ফাঁস করি।’

ওসমেনা তখন জানতে চান, অস্তিত্বই নেই এমন জমাদাতা যদি তথ্য জানতে চায়, তাহলে তখনও তারা তথ্য জানান কিনা। উত্তরে এস্তাভিলো বলেন, ‘এ ঘটনার পর তো আমরা আইনের ফাঁকফোকর দেখলাম। আশা করি, বিষয়টি আপনারাও নজরে আনতে পারবেন।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করতে আইনের সংশোধন করতে হবে... এমনকি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থারও কিছু বিষয়ে কর্তৃত্ব নেই।’ ফার্নান্দেজ-এস্তাভিলো এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য একটি নির্বাহী সেশন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অর্থ স্থানান্তরের পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে আলোচনা করা দরকার।

এদিকে আরবিসির প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জ তান দাবি করেন, অর্থ স্থানান্তরের পর তিনি এসব বিষয়ে জানতে পারেন।  -যুগান্তর
৩০ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে