শনিবার, ০২ এপ্রিল, ২০১৬, ০৪:৩৩:৩৪

আতিউরের ভারত সফর : রোম যখন পুড়ছিল

আতিউরের ভারত সফর : রোম যখন পুড়ছিল

নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর ড. আতিউর রহমান কী কারণে তার ভারত সফর বাতিল করতে পারেননি সে বিষয়টি এখনও অনুদঘাটিত রয়েছে। তবে তিনি তার নিকটজনদের কাছে দুটি ভুল স্বীকার করে থাকেন বলে জানা যায়।

প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে খোয়া যাওয়া রিজার্ভ সম্পর্কে তথ্য গোপন করা। দ্বিতীয়ত, তার ভারত সফরে যাওয়া। এর মধ্যে গোপন করা সম্পর্কে কথিত মতে তার ব্যাখা হচ্ছে তিনি চেপে রাখতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, টাকাটা উদ্ধার করতে পারবেন। এ দাবির কারণে অনেকে তাকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে চাইছেন। কিন্তু মুশকিল হল ভারত সফর সম্পর্কে তিনি কী বলবেন?

এ বিষয়ে তিনি কেবল এতটুকুই বলছেন যে, এই সফরে যাওয়া তার সমীচীন হয়নি। এই সফরটি সম্পর্কে অনেকেই তার কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। কারণ, সফরটি তিনি এমন এক সময়ে করেছেন, যার সঙ্গে অনেকেই একটি রোমান প্রবাদ স্মরণে আনছেন। প্রবাদটি হলো, ‘রোম যখন পুড়ছে তখন সম্রাট নিরোর বাঁশির সুর মধুর থেকে মধুরতর হচ্ছে।’

ড. আতিউর তার মেয়াদে বিদেশ সফরে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে একটা পাল্লা দিয়েছিলেন। রাজনীতিকরা অনেক সময় বলে থাকেন যে, তারা অনেক সময় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও মন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়ে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেন। কিন্তু বিশ্বের কোথাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিগ বসের পদটিকে রাজনৈতিক নয় বরং হাইলি টেকনিক্যাল মনে করা হয়। বিষয়টি মোটেই এমন ছিল না যে, তিনি বিদেশে দৌড়ঝাঁপ করে রিজার্ভের অঙ্ক বাড়িয়েছিলেন।

এখন অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর হিসেবে তিনি সেই বিশ্ব ব্যাংকের যমজ ভাই হিসেবে পরিচিত আইএমএফ-এর সেমিনারে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। আইএমএফ এবং ভারত সরকার অবশ্য যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করেছিল।

 আইএমএফ-এর ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, তারা এই সেমিনারের নামকরণ করেছিল ‘অ্যাডভান্সিং এশিয়া : ইনভেস্টিং ফর দ্য ফিউচার।’ ১১-১৩ই মার্চ অনুষ্ঠেয় এই সেমিনারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন প্রধান অতিথি। তার সঙ্গে সেদেশের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এসেছিলেন। আর সেই আসরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অন্য বিষয়ের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের মর্যাদাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।

আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হতে থাকা বিশ্ব ব্যাংক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের উদ্যোগে বিশ্ব ব্যাংকের পাল্টা একটি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগকে রুখে দিতে চাইছে বলে মনে করা হয়। চীনের নেতৃত্বে বিশ্ব ব্যাংকের পাল্টা উদ্যোগ হিসেবে গণ্য হওয়া ব্রিকস ব্যাংক নিয়ে ভারতও আগ্রহ দেখিয়েছে।

কিন্তু গত ১১-১৩ই মার্চে দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় সেমিনারে প্রকৃত পক্ষে বিশ্বব্যাংক কী করে ভবিষ্যৎ এশিয়া বিনির্মাণে বৃহত্তর ভূমিকা রাখবে সেটাই ছিল প্রধান আকর্ষণ। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় এজেন্ডা হিসেবে ছিল না। বিষয়টি অনেকটাই একাডেমিক ছিল। ওয়াকেবহাল মহল বলেন, এ ধরনের সেমিনার বিশ্বে কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

জানা  গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর হিসেবে তিনি নিয়মনীতি মেনেই অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার সমালোচকদের মতে, তিনি ওভার স্মার্টনেস দেখাতে চেয়ে থাকতে পারেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে হবে। আর তার দিল্লি সফরের ধারণা নিরোর বাঁশি বাজানোর মতো মোহাচ্ছন্নতা থেকেই ঘটে থাকতে পারে। তিনি যেহেতু গোপনীয়তা বজায় রাখতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন তাই ঝুকি নিয়ে হলেও তিনি দিল্লি সফর বাতিল করার ঝুঁকি নেননি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি এই টাকা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটতো তাহলেও তিনি তা এতগুলো সপ্তাহ তা লুকিয়ে রাখতে গেলেন কেন? কারণ ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন ধরে নিলেও দীর্ঘ ৩৪ দিন পরে তিনি ‘স্বাভাবিকতা’ দেখাতেই ভারত সফরে গেলেন, বিষয়টিকে অনেকেই এতখানি নিরীহ ভাবতে রাজি নন।

দিল্লির সেমিনারে যা বলা হলো- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার লিখিত ভাষণে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে ভারত বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেসের’ সূচকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। আর ভারত তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী ও আসিয়ানের সঙ্গে নানা মাত্রা ও গতিতে সমন্বিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩০টির বেশি দেশ থেকে  ‘কর্মকর্তা, একাডেমিক, কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের আহ্বান করেছিল আইএমএফ।’ সেখানে মন্ত্রীদের উল্লেখ ছিল না। নির্দিষ্টভাবে এটাও বলা ছিল না যে, এটা এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের কোনো সম্মেলন। আইএমএফ এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেখা যায়. ড. আতিউর এই ৩০টি দেশের মধ্যে একমাত্র গভর্নর, যিনি প্যানেলভুক্ত আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। তাছাড়া এই ৩০টি দেশের মধ্যে আর কোনো দেশের গভর্নরের অংশগ্রহণের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। এমনকি কোনো উল্লেখযোগ্য দেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি আসেননি।

আইএমএফ তার প্রেস রিলিজে বলেছিল মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. জেটি আক্তার আসবেন। কিন্তু তিনি আসেননি। গত ১৪ই মার্চ বাসস এবিষয়ে ড. আতিউরের বরাতে যে খবর প্রকাশ করে তাতেও দেখা যায়, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের গভর্নরের অংশগ্রহণের কথা নেই। বাসসের খবরে বলা হয় ড. আতিউর সেখানে জলবায়ু ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছেন যা তার থেকে অনেক নিচের প্রতিনিধিকে দিয়েও বলানো সম্ভব ছিল।

জাপানের একজন সাবেক ও বর্তমান ভাইস মিনিস্টার এসেছেন। অর্থমন্ত্রী এসেছেন ফিজি ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। তার মানে দাঁড়ালো ভারতের বাইরে সার্ক থেকে সব থেকে লক্ষণীয় হলো, মালদ্বীপের মতো দেশও তার গভর্নরকে পাঠায়নি। সে দেশটি থেকে এসেছে মনিটরি অথরিটির গভর্নর মিজ ড. আজিমা।

১২ই মার্চ ড. আতিউর যে সেশনে প্যানেলিস্ট ছিলেন সেখানে জলবায়ু নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ড. রঘুরাম রাজন। চারজন নির্ধারিত আলোচকদের মধ্যে ড. আতিউর অন্যতম। অন্যরা ছিলেন এডিবি প্রেসিডেন্ট তাকিহিকো, ফিজির অ্যাটর্নি জেনারেল ও অর্থমন্ত্রী আইয়াজ সৈয়দ ও ইউএনডিপর প্রশাসক হেলেন ক্লার্ক।   সূত্র : মানবজমিন
২ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে