শনিবার, ০৯ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:০১:০১

ভয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন নাজিমুদ্দিন সামাদ

ভয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন নাজিমুদ্দিন সামাদ

 

নিউজ ডেস্ক : ভয়ে ঢাকা ছেড়ে নিজ বাড়ি বিয়ানীবাজারে চলে এসেছিলেন ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ। ১০ দিন তিনি বাড়িতেই কাটিয়েছেন। কোথাও বের হননি। এমনকি সিলেটে এলেও ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ওই সময় তিনি ফেসবুক বন্ধ রাখেন। ঢাকায় নিহত নাজিমুদ্দিন সামাদের সিলেটের বন্ধুরা গতকাল এসব কথা জানিয়েছেন।

তারা বলেছেন, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন খুন হওয়ার পর সামাদ কিছুটা ভয় পেয়ে যান এবং তার ওপরও হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। এ কারণেই ওই ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি নিজ বাড়িতে এসেছিলেন। সিলেটের বিয়ানীবাজারের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকরা গতকাল জানিয়েছেন, নাজিমুদ্দিন সামাদকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হতো বলে তারা খবর পেয়েছিলেন। তবে, এসব বিষয় সামাদ কখনো আমলে নেননি। কিন্তু সর্বশেষ গত ৩০শে অক্টোবর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার পরপরই সামাদ কিছুটা তটস্থ হন। তিনি ভয় পেয়ে যান।

ওই হত্যাকাণ্ডের পর তিনি কিছুদিন ঢাকায় থাকলেও পরবর্তীতে নিজ বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের মাটিজুড়ি গ্রামে চলে আসেন। ওখানে তিনি ১০ দিন বসবাস করেন। তবে, সামাদ ওই সময় বেশ শান্ত হয়ে যান। এমনকি তিনি নিজের ফেসবুকও ব্যবহার করেননি। তবে, মাঝে মধ্যে সামাদ বিয়ানীবাজারে যেতেন। আবার কখনো কখনো সিলেটে এসে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে দেখা করতেন।

এর বাইরে সামাদ কারও সঙ্গে মিশেননি। নিহত সামাদের স্কুল জীবনের সহপাঠী সিলেট জেলা সিপিবি নেতা গোলাম রাব্বি চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সামাদ সিলেটে এসেছিল। তখন তাদের সঙ্গে সামাদের দেখা হয়েছে। সিলেট নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে সামাদ শরিক হয়েছে। ওই সময় সামাদ সহপাঠীদের কাছে ফেসবুক বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে।

সামাদ জানিয়েছিল, ‘কিছুটা চাপে আছি, তাই অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ করে রেখেছি।’ এদিকে গতকাল লাশ দাফনের পর সামাদের চাচাতো ভাইরা জানিয়েছেন, সামাদ পড়ালেখা করতে চেয়েছে। কিছুতেই পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটুক তা চাইতো না। পরিবারের সব পুরুষ সদস্যরা দেশের বাইরে থাকায় দেশে থাকা বৃদ্ধ মাকেও সে দেখাশোনা করতো। তাছাড়া লেখালেখি বা হুমকির বিষয়ে সে পরিবারের কারও সঙ্গে কোনোদিনই কিছু বলেনি।

সামাদের ডায়েরি: সামাদের একটি ডায়েরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ডায়েরিতে অনেক কথা লিখে গেছেন সামাদ। ডায়েরিতে মৃত্যু সম্পর্কে সামাদ লিখেছেন, ‘কার, কখন, কোথায়, কিভাবে মৃত্যু হয় কেউ জানে না। মৃত্যু আমার কাছে ভয়ের কোনো বিষয় নয়। এটা জীবনেরই একটা শাশ্বত প্রক্রিয়া। আমার কাছে মৃত্যু একটা গভীর ঘুম- যেখানে কোনো শব্দ-বর্ণ-অনুভূতি ও স্বপ্ন থাকে না। মৃত্যু মানে একটি রূপের চূড়ান্ত ধ্বংস। যদি ধ্বংসের রেসে যেতে পারো তবে প্রাণ চলে যাবে অন্য ‘রূপে’। এভাবেই যদি প্রাণ নতুন ‘রূপ’ লাভ করে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনে’ নতুন প্রজাতির উৎপত্তি করে ও লক্ষ লক্ষ প্রজাতিতে পৃথিবী মুখরিত হয়। আমার মৃত্যু হলে এই নশ্বর দেহটি যেন কোনো মেডিকেলে দিয়ে দেয়া হয়। কবরে কীট পতঙ্গে খাওয়ার চেয়ে অথবা আগুনে জ্বলার চেয়ে তা কোনো মানব হিতৈকর কাজে লাগুক। জয় হোক মানবতার।

সন্দেহভাজনরা নজরদারিতে: একরামপুর মোড়ের ঋষিকেশ দাশ রোড। দিন-রাত সবসময়ই মানুষের সমাগম। সেখানেই হত্যা করা হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিনকে। হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে তাকে কোপালেও কেউ এগিয়ে যায়নি। এমনকি তার সঙ্গী বন্ধুটিও আতঙ্কে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন দ্রুত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন কয়েক জনকে নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে চিহ্নিত কয়েক জঙ্গি রয়েছে। এ ছাড়াও ঘটনার সময় সঙ্গে থাকা বন্ধু সোহেলকে পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ। সেইসঙ্গে তার ফেসবুকের কয়েক বন্ধু রয়েছেন এই তালিকায়। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নাজিমের স্বজনরা মামলা করতে আগ্রহী না হওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।

পুলিশের ধারণা হত্যাকাণ্ডের আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকেই খুনিরা নাজিমুদ্দিনকে অনুসরণ করছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের ছাত্র নাজিমুদ্দিন ক্লাস শেষ করে ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার সহপাঠী বন্ধু সোহেল আহমেদ। কথা ছিল ওই রাতেই সিলেটে যাবেন অসুস্থ মাকে দেখতে। কিন্তু তার আর সিলেটে যাওয়া হয়নি। একরামপুর মোড়ের ঋষিকেশ দাশ রোডের ৩৬ নম্বর দোকানের সামনে আসার পরই পেছন থেকে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় নাজিমের বন্ধু সোহেল সঙ্গে থাকলেও তাকে আঘাত করেনি হামলাকারীরা। তাৎক্ষণিকভাবে আতঙ্কে তিনি পালিয়ে যান বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

সুবর্ণা টেইলার্সের সামনের সিঁড়ি ও ড্রেনের কাছেই নাজিমুদ্দিনের নিথর দেহ পড়ে ছিল। ঘটনাস্থলের পাশের একটি দোকানের কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দোকানে তখন তিনি একাই ছিলেন। এক যুবককে ঘিরে কয়েকজন কোপাচ্ছে দেখতে পান তিনি। এ সময় আশপাশের দোকানগুলো শাটার টেনে বন্ধ করা হচ্ছিলো দেখে তিনি তার দোকানের শাটার টেনে বন্ধ করেন। এ সময় গুলির শব্দও শুনতে পান। দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নাজিমের লাশ উদ্ধার করে। এ সময় তার একটি হাত ব্যাগ পাওয়া যায়। এতে কাগজ, কলম, মোবাইলফোন ও তার আইডি কার্ড ছিল। লাশের পাশে একটি গুলির খোসা পাওয়া গেছে। এতে ৩১১ লেখা ছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে নাজিম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল নাজিমের লাশ তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। তার আগে নাজিম হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত চার-পাঁচ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় নাজিমের স্বজনরা মামলা করতে আগ্রহী হননি বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে পুলিশের সূত্রাপুর জোনের সহকারী কমিশনার নুরুল আমিন বলেন, নাজিমের স্বজনরা মামলা করতে আগ্রহী হননি। তার চাচাতো ভাই লন্ডন প্রবাসী বদরুল হক জানিয়েছেন, মামলা করে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না তারা। তাই বাধ্য হয়েই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে সূত্রাপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

মামলা দায়েরের পর গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের সহকারী কমিশনার নুরুল আমিন, সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা। এ সময় তারা আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, নাজিম ঢাকায় এসেছেন মাত্র তিন মাস আগে। সিলেটে তার কোনো শত্রু ছিল কি-না এ বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে ফেসবুকে তার বিভিন্ন স্ট্যাটাসে কে কি ধরনের মন্তব্য করতেন তাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানান ওসি।

পুলিশের পাশাপাশি মামলাটি তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। নাজিমের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। তার ফোনের কললিস্ট ও ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাস ও মন্তব্যকে তদন্তের আওতায় নিয়ে কাজ শুরু করেছে ডিবি। ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখির কারণে তাকে কেউ হুমকি-ধমকি দিয়েছে কি-না এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

সূত্রমতে, ইতিমধ্যে সন্দেহভাজন কিছু উগ্রপন্থিদের তালিকা করে তদন্ত করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানা গেছে। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর সূত্রধর জানান, সন্দেহভাজনদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। নাজিমুদ্দিন গেন্ডারিয়ার রজনী কান্ত রোডের একটি বাড়িতে মেসে থাকতেন। গতকাল দুপুরে ওই বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিন মাস আগে সিলেট থেকে ঢাকায় এসে ওই মেসে উঠেন তিনি।

নাজিম হত্যার খবর পেয়ে তার চাচাতো ভাই লন্ডন প্রবাসী বদরুল হক বৃহস্পতিবার বিকালে দেশে ফিরেন। আইনি প্রক্রিয়া শেষে রাত ১১টা ২০ মিনিটে সূত্রাপুর থানার মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে লাশ গ্রহণ করেন নাজিমের ভাইপো জাহিদুল হক সুমন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে নাজিমের লাশ তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টুকাভরাউটে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টায় সেখানে লাশ পৌঁছালে স্থানীয় লোকজন ও স্বজনরা ভিড় করেন। সকাল ১১টায় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।  -এমজমিন

৯ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে