রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ০৯:৫১:২৩

‘ক্যামেরায় ধারণ করছিলাম, হঠাৎ পুলিশ গুলি ছুড়লে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি’

‘ক্যামেরায় ধারণ করছিলাম, হঠাৎ পুলিশ গুলি ছুড়লে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি’

আল-আমিন: দুপুরের আগ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। দুপুরের পর হঠাৎ বিশৃঙ্খলা। একদল লোক ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে ভোটারদের লাইন থেকে তাড়াতে থাকে। ভোটাররা ভয়ে কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই দৃশ্য আমি ক্যামেরায় ধারণ করছিলাম। হঠাৎ কোন কথা না বলেই পুলিশ আমার পায়ে গুলি ছোড়ে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।

গত ৩১শে মার্চ ভোলার সদর থানার দক্ষিণ রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন এনটিভির জেলা প্রতিনিধি আফজাল হোসেন। ওই ঘটনায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

এরপর থেকে ১০ দিন ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তিনি। অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় ভোলা থেকে তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে এ কয়দিনেও আহত এই সাংবাদিকের খোঁজ নেয়নি নির্বাচন কমিশনের কেউ।

আফজাল জানিয়েছেন, কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই গুলি করেন পুলিশের কনস্টেবল জুলহাস। এরপর দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন তিনি। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মানবজমিনকে তিনি বলেন, চারদিকে হই-হুল্লোড়। দখল ও জাল ভোটের মহোৎসব চলছিল। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ধাওয়ায় ভোট কেন্দ্র লাইনে দাঁড়ানো থাকা ভোটাররা জীবন নিয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। ওই সময় ভোট কেন্দ্র দখলের ফুটেজ ক্যামেরায় ধারণ করছিলাম। এ দৃশ্য দেখে কনস্টেবল জুলহাস সরাসরি আমার কাছে এসে কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই বাম পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার জীবন এখন ঝুঁকির মধ্যে। আমি পঙ্গু হলে আমার পরিবারের কি হবে? আফজাল বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল সকালে ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পায়ের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি কাতরাচ্ছিলেন। স্ত্রী ফাতেমা বেগম তার শুশ্রূষা করছিলেন। তার বাম পা থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তিনি আশঙ্কামুক্ত নন। আফজাল হোসেন জানান, ঘটনার দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ নম্বর ভোট কেন্দ্র যান। ওই ইউনিয়নের দুইজন প্রার্থী ছিলেন।

ওই ভোট কেন্দ্রে গেলে স্থানীয় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন যে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক জাল ভোট দিচ্ছেন। ভোট কেন্দ্রে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন বাধা দেন।

তিনি আরও জানান, ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা প্রকাশ্যে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরতে থাকেন। ভাঙচুর করা হয় চেয়ার ও টেবিল। ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয় নারী ও পুরুষ ভোটারদের। এসব ঘটনা ঘটে ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামাল হোসেনের সামনেই। পুলিশ ও বিজিবি ছিল নির্বিকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় কয়েকজন বিএনপির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য চাইলেও তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে বিজিবির মেজর এসে হ্যান্ড মাইকে ভোটারদের ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু, তখন আর কোনো ভোটারদের মধ্যে ওই আহ্বানে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

তিনি দাবি করে জানান, তাকে যে গুলি করা হয়েছে সেখানে এক বিজিবির সদস্য স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে ওই পুলিশের কনস্টেবলকে দেখিয়ে দেন। তখন অন্য সব পুলিশ সদস্যদের নির্দেশে দ্রুত জুলহাস রাইফেল থেকে গুলি বের করে পকেটে লুকিয়ে সেখান থেকে চলে যান। পরে আমার কয়েকজন সহকর্মী আমাকে ভোলা সদর হাসপাতালে ও পরে বরিশাল শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার চিকিৎসকেরা আমাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়।

আফজাল বলেন, কেন্দ্র দখলের ফুটেজ নেয়ায় গুলি করা হয়েছে। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ঘটনার সময় ওই স্থানে আরও কোনো সাংবাদিক ছিল কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, কয়েকজন জেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তারা আমার কাছ থেকে একটু দূরে ছিলেন। আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমার কাছে ছুটে আসেন।

তিনি জানান, নির্বাচন কমিশনে আমার ওই ঘটনাটি জানানো হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান মনিরকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু, ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত আমার প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম জানান, আমাদের পরিবারের মধ্যে একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি হলেন আমার স্বামী। তার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। তিনি যদি পঙ্গু হয়ে যান তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কি হবে? আফজাল এনটিভির ভোলা জেলার স্টাফ করসপনডেন্ট ছাড়াও দৈনিক মানবকণ্ঠ ও রেডিও টুডের জেলা সংবাদদাতা। এ ছাড়াও তিনি ভোলা জেলা প্রেস ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ।  তার বাবার নাম মরহুম মকবুল হোসেন। -এমজমিন
১০ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে