বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ০৪:৪৬:৫৭

মূল ঘাতকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

মূল ঘাতকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

শাহীন করিম : চাঞ্চল্যকর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে সারাদেশে অব্যাহত রয়েছে প্রতিবাদ।

রাজধানীর পুরান ঢাকায় মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেন হত্যা, মিরপুরের শাহআলীতে চা-দোকানি বাবুল মাতব্বরকে জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে হত্যা ও মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেলের কর্মচারী রিয়াদকে মালিকের গুলি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বহুল আলোচিত পাঁচ হত্যাকাণ্ডের পর অনেক দিন গড়িয়ে গেলেও মূল ঘাতকরা এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলার তদন্ত চলছে কুলকিনারাহীনভাবে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন নিয়ে ধোঁয়াশাও কাটছে না বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

কলেজছাত্রী তনু হত্যা: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হতাকাণ্ডের পর ২৪ দিন পেরিয়ে গেলেও খুনিদের গ্রেফতার তো দূরের কথা এখনো শনাক্তই করতে পারেনি পুলিশ। থানা পুলিশ ও ডিবির হাত ঘুরে সাড়া জাগানো এ মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি। কিন্তু চাঞ্চল্যকর তনু হত্যার রহস্য নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে তনুর পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী, সেনা সদস্য ও চিকিৎসকসহ এ যাবৎ শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন সিআইডি কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ রোববার তনুর প্রথম দফা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কামদা প্রসাদ সাহা ও শারমিন সুলতানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাই আলোচিত কলেজছাত্রী তনু হত্যা মামলার তদন্ত এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। এদিকে ১৬ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটক থাকার পর মঙ্গলবার সকালে ফিরে এসেছে তনুর ভাই আনোয়ারের বন্ধু কলেজছাত্র মিজানুর রহমান সোহাগ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সোহাগকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে পরিবার থেকে অভিযোগ করা হলেও পুলিশের কোনো সংস্থা তা স্বীকার করেনি।

উল্লেখ্য, ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের নিজ বাসার অদূরে তনুর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

জবি ছাত্র নাজিমউদ্দিন হত্যা: ৬ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর সূত্রাপুরের হষিকেশ দাস লেনের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিন সামাদকে। ফের আরেক লেখককে আগের মতোই একই কায়দায় হত্যার ঘটনায় দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। খুনিদের বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। নাজিম হত্যার পর থেকে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্র্থীরা।

কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও খুনিদের নাগাল পায়নি পুলিশ। তবে এ হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহর জঙ্গিরা জড়িত বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। তবে ফেসবুকে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখিকে কেন্দ্র করে নাকি ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তাও শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তাছাড়া কারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত এ নিয়ে ধোঁয়াশা পুরোপুরি কাটেনি।

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম মনে করেন, জবি ছাত্র অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করেছে। তদন্ত শেষে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। আর সূত্রাপুর থানার ওসি তপন কুমার সাহা বলেন, নাজিম হত্যার তদন্তে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তবে খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।

ইসলামপুরে মুয়াজ্জিন বেলাল হত্যাকাণ্ড: ৩ এপ্রিল রাতের কোনো এক সময়ে পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন সকালে সেখান থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডের পর ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও ঘাতকদের শনাক্ত কিংবা গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বেলাল হত্যার নেপথ্যের রহস্যও উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। তবে মুয়াজ্জিন বেল্লাল হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে ওই মসজিদের ইমাম তাজুল ইসলামসহ দু’জনকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য মেলেনি বলে পুলিশ সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে খুনিদের কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, বেলাল হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের ইমাম তাজুল ইসলাম ও মুসল্লি সারোয়ার হালিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর পর আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া খুনিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

শাহআলীতে চা-দোকানি বাবুল হত্যা: রাজধানীর মিরপুরের শাহআলী থানাধীন গুদারাঘাটে চা-দোকানি বাবুল মাতবরকে জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে হত্যার প্রধান আসামি পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) দেলোয়ারকে দীর্ঘদিনেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর দুই মাসেরও বেশি সময় গড়িয়ে গেলেও হোতা দেলোয়ারসহ পাঁচ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এতদিনেও প্রধান আসামির ঠিকানাই নিশ্চিত হতে পারেননি বলে দাবি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মীর রেজাউল ইসলাম।

আলোচিত বাবুল হত্যার ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শাহ আলী থানার তৎকালীন ওসিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ঘটনার দিন দায়িত্বে নিয়োজিত না থাকায় বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজন এসআইকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ওসিসহ বাকি চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে। এই তদন্তেও দোষী সাব্যস্ত হলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে নয়টার দিকে শাহআলী থানার চার পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে তাদের সোর্স দেলোয়ার চাঁদা দাবি করেন গুদারাঘাটের চ-দোকানি বাবুলের কাছে। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় বাবুলকে লাথি মেরে কেরোসিন তেলের জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে দেয় দেলোয়ার। এতে বাবুলের সারা শরীরে আগুন ধরে শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মারা যান বাবুল। আলোচিত এ ঘটনার পর শাহ আলী থানার তৎকালীন ওসি এ কে এম শাহীন মণ্ডল ও দুই এসআইসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

মতিঝিলের ঘরোয়ার কর্মচারী হত্যা: মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেলের কর্মচারী রিয়াদকে গুলি করে হত্যার প্রায় ছয় মাসেও প্রধান আসামি হোটেল মালিক আরিফুর রহমান সোহেলকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। সোহেলকে কোথাও ‘খুঁজেই’ পাওয়া যাচ্ছে না- দাবি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার। আসামি পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন নিহতের স্বজনরা।

মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে ওয়ারীর স্বামীবাগ এলাকার নির্মাণাধীন ভবনে গত বছরের ২৭ অক্টোবর রাতে মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কিশোর কর্মচারী রিয়াদকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেন সোহেল ও তার সহযোগীরা। হত্যাকাণ্ডটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হওয়ার গল্প সাজান হোটেল মালিক সোহেল।

পুলিশ সূত্র জানায়, কিন্তু ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ভেসে ওঠে রিয়াদকে গুলি করে হত্যার কাহিনী। পরে প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানান, তাদের সামনেই ঘরোয়ার মালিক সোহেল তার কর্মচারী রিয়াদকে গুলি ও পিটিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় নিহতের ভাই রিপন হোসেন বাদী হয়ে সোহেল, জসীম ও খবিরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে ঘটনার পরপর শুধু জসীমকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওয়ারী থানার ওসি জেহাদ হোসেন বলেন, প্রধান আসামি আরিফুর রহমান সোহেলকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে। সোহেলকে গ্রেফতারের পর আদালতে তার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আরো নতুন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। জবানবন্দিসহ চার্জশিট দিলে বিচার প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের কঠোর শাস্তির পথ সুগম করবে বলে মন্তব্য করেন ওসি। - সূত্র : মানবকণ্ঠ
১৪ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে