ফিরোজ আমিন সরকার : ওই তুই আমাকে ছেড়ে গেলি আর ২৫ বছরে একবারও মনে পড়লো না। কেমন তুই? ছেলে দুটোকে দেখে আমার বুকের পাঁজরের হাড় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আয় বাবা তোদের বুকে জড়িয়ে ধরি। স্ত্রী জয়গুন, ছেলে জয়নাল ও আইনুলকে উদ্দেশ্য করে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় ধর্মগড় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ধরে এ কথা বলে হাউ মাউ করে কাঁদছিল ইমানদু মোহাম্মদ।
ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের ঝাঁড়বাড়ি গ্রামের ইমানদু মোহাম্মদ বৃহস্পতিবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সকাল থেকে জড়ো হয় ধর্মগড় সীমান্তে। সীমান্তের কুলিক নদীর কোমর পানি ভেঙে পার হয়। এর পর বেলা ১১টায় কাঁটাতারের কাছে গিয়ে খুঁজতে থাকে দ্বিতীয় স্ত্রী জয়গুন ও দুই ছেলেকে।
হাজারো মানুষের ভিড়ে বের করতে না পেরে হাঁ হুতাশ করছিল। মোবাইল ফোনে নেটও তেমন নেই। এক সময় ফোন করার সুযোগ পায় খুঁজে পায় স্ত্রী সন্তানদের। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই
পারে তাদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
স্বামী ইমানদু মোহাম্মদ স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুই এভাবে চলে যাবি আগে জানলে যেতে দিতাম না। আর ছেলেদের জন্য আমাকে কাঁদতে হয় প্রতিদিন। ওদের (ছেলেদের) কি আর আমি দেখতে পাবো না? স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতে কাজের উদ্দেশ্যে গেলে ইমানদু বিয়ে করে জয়গুনকে। বিয়ের পর জয়গুনকে বাংলাদেশে আনে। জয়গুন ইমানদুর দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের ১২ বছরে ৪ ছেলের মা হয় জয়গুন। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বের জেরে জয়গুন দুই সন্তান জয়নাল ও আইনুলকে নিয়ে ভারতে বাবার বাড়ি ফিরে যায়। এর পর আর ফেরেনি। সেখানে জয়গুনকে তার বাবা-মা অন্যত্র বিয়ে দেয়। সেই থেকে দুজন দু-প্রান্তে। আর কথাও হয়নি। দেখাও হয়।
সম্প্রতি ধর্মগড় গ্রামে মজিরুল ভারতে কাজের জন্য গেলে দেখা হয় ইমানদুর ছেলে আইনুলের সঙ্গে। ফোন নম্বর এনে ইমানদুকে দেয়। অপেক্ষায় থাকে পহেলা বৈশাখের।
রাণীশংকৈল উপজেলার মহলবাড়ি গ্রামের মংলু বড় ভাই শংকর রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দুপুর ২টা পর্যন্ত ভারতের থোকরা বাড়িতে থাকা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। বড় ভাইয়ের জন্য মুড়ি, চিড়া, গুড়। গত দুই বছর ধরে তার সঙ্গে দেখা হয়নি বলে জানান মংলু রায়। ধর্মগড় ভরনিয়া গ্রামের আবদুর রহিম এসেছেন ভারতের মালদহ এলাকায় থাকা দাদার সঙ্গে দেখা করতে। এবার দেখা করে নাতি রহিম খুবই আনন্দিত।
বর্ষবরণ উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারো ঠাকুরগাঁওয়ে জেলার ৪টি সীমান্তে হয়ে গেল দুই বাংলার মানুষের মিলন মেলা।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় সীমান্তে দুই বাংলার মানুষের দেখা করার সুযোগ দেয় বিএসএফ ও বিজিবি। এ সময় আত্মীয়স্বজনা কাঁটাতারের কাছে গিয়ে দেখা করে। এই সুযোগে একে অপরে সঙ্গে কুশল ও বৈশাখী শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি পছন্দের খাবার আঙ্গুর, আপেল, মুড়ি, চিড়া, দই, শাড়ি কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র আদান-প্রদান করে। দীর্ঘ দিন পর দেখা করার সুযোগ পেয়ে অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে একে অপরে ছুয়ে দেখার চেষ্টা করেন।
এ ছাড়াও জেলার হরিপুর উপজেলার বুজরুক, বেতনা, কান্দাল সীমান্তে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে এপার-ওপার মানুষের দেখাকরা সুযোগ। সরকারিভাবে এ ধরনের সুযোগ বছরে একবার করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বজনরা।
ধর্মগড় ইউনিয়নের নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম মুকুল বলেন, এধরনের আয়োজন হওয়া প্রয়োজন। এলাকার অধিকাংশ মানুষ গরিব। পাসপোর্ট ভিসা করে তাদের দেখা করার অর্থ জোগান দেয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।-এমজমিন
১৪ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এএম