মুসতাক আহমদ : বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানলে এর পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের তেমন প্রস্তুতি নেই। গত বছরের এপ্রিলে নেপালে বা বুধবার মিয়ানমারে আঘাত হানা ভূমিকম্পের সমান মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশের ভেতরে বা কাছাকাছি আঘাত হানলে ঢাকা বা বড় শহরগুলো যেমন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে, তেমনি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাও কঠিন হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ বা এ সম্পর্কে আগাম তথ্য-উপাত্ত পাওয়া সম্ভব নয়। তবে ভূমিকম্পের কারণে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এছাড়া ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, তথ্য-উপাত্ত ও নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমদ আনসারী শুক্রবার জানান, বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবেলা ও পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে প্রস্তুতি খুব একটা নেই। এ নিয়ে নানাকথা হলেও যেভাবে প্রস্তুতি নেয়া দরকার তা হয়নি। গত বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালে প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের পর সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো লাল চিহ্নিত করে দেয়া হবে। কিন্তু তা আজও হয়নি। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় নেপাল, মারা যায় ৮ হাজারের বেশি মানুষ।
এদিকে বুধবার মিয়ানমারে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে গোটা বাংলাদেশও কেঁপে ওঠে। হেলে পড়ে অন্তত ১০টি ভবন, আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ। এরপর বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে।
ড. আনসারী বলেন, বুধবার মিয়ানমারের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এর কারণ, এই প্লেটের সঙ্গে বাংলাদেশের প্লেট আলাদা। কিন্তু দেশের বাইরে দুটি ফল্টে (ভূচ্যুতি) ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। একটি হচ্ছে- সিন্ধুকুশ থেকে আসাম-মেঘালয় পর্যন্ত যে ‘মেইন বাউন্ডারি থ্রাস্ট’ (এমবিটি) গেছে। এ ফল্টে গত ৫শ’ বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। অপরটি হচ্ছে- মিয়ানমারের আরাকান ফল্ট। এখানে সর্বশেষ ভূমিকম্প হয় ১৭৬২ সালে।
সাধারণত বড় একটি ভূমিকম্পের পরবর্তী দেড়শ’ থেকে আড়াইশ’ বছরের মধ্যে বড় আরেকটি ভূমিকম্প হয়। সেই বিবেচনায় এই দুটি ফল্ট যে কোনো সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। তাই বিষয়টি মাথায় রেখে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখা জরুরি।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) অনেকদিন ধরে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করে আসছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমদ আনসারী বলেন, ইউএনডিপি বর্তমানে রাজউকের সঙ্গে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কাজ করছে। বিল্ডিং কোড মেনে যদি রাজউক ভবন তৈরি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে সেটা ভূমিকম্প মোকাবেলায় একটি কাজ হবে।
২০০৪ সালে ‘কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সিডিএমপি) বা সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি শুরু হয়। দুটি পর্যায়ে এই পরিকল্পনায় ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ইতিমধ্যে তৈরি ও সংরক্ষণ করা হয়েছে।
সিডিএমপির আওতায় ভূমিকম্প ও দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে গবেষণা, ‘লাইফ-লাইন’ গবেষণা, বাংলাদেশ জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার (বিএনবিসি) জন্য কারিগরি ও তাত্ত্বিক নির্দেশনা, গৃহঋণ সংস্থার মাধ্যমে নির্মাণ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ‘ফল্ট জোন’ চিহ্নিত করা, সম্ভাব্য ভূমিকম্প ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণে এলাকাভিত্তিক ‘মাইক্রো জোনেশন’ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় ৬২ হাজার ‘শহরভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক’ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৩০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত সিডিএমপির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ছিল প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ছিল ৭২ লাখেরও বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬১ হাজার। তখন রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের ভবনের সংখ্যা ছিল প্রায় সোয়া তিন লাখ। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভবনের বয়স ৩০ বছর কিংবা তারও বেশি। মোট ভবনের প্রায় ৪০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘মধ্যম’ মানের ভবন ৩৫ শতাংশের মতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান থেকেই অনুমান করা যায়, বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় কী বিপুল প্রাণহানি হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল ভূমিকম্প ও ঢাকা শহরের উদ্ধার তৎপরতা বিষয়ে গবেষণা করে থাকেন। তিনি বলেন, এ ধরনের ভূমিকম্পে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে অনেক বেশি। বিশেষ করে ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। রিখটার স্কেলে সাত বা তার বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে। টেলিসংযোগ, পানি সরবরাহ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইনে বিপর্যয়সহ অগ্নিকাণ্ডের আশংকা আছে। এমন পরিস্থিতিতে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ সমন্বয় দুরূহ হয়ে পড়ে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্ভাব্য দুর্যোগে সামাল দিতে আছে একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় মাত্র ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশন রয়েছে। এর ১১টির ভবনের অবস্থাই নাজুক। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে এসব ভবনই ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া নেই পর্যাপ্ত কর্মী, গাড়ি ও অন্যান্য উদ্ধার সরঞ্জাম।
গত বছরের নেপালের প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের পর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ওই সভায় ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। সেন্টার থেকে দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগোত্তর পরিস্থিতিতে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ পরিচালনা, সমন্বয়, নির্দেশনা ও পযর্বেক্ষণ করা হবে। কিন্তু ওই সেন্টারের কার্যক্রম তেমন এগোয়নি।
অধ্যাপক মেহেদী আহমদ আনসারী বলেন, ভূমিকম্পে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে যেসব কাজ করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ করা। এছাড়া নতুন ভবন ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ এবং পুরনো ভবনকে রেক্টোফিট (মজবুতি) করা। নতুন ভবনকে ভূমিকম্প সহনশীল করলে স্বাভাবিক খরচের সঙ্গে মাত্র ১৫-২০ টাকা বেশি যুক্ত হবে। তবে রেক্টোফিটিংয়ে প্রতি বর্গফুটে প্রায় ৬০০ টাকা খরচ হবে।
প্রস্তুতি হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল রেক্টোফিট করতে হবে। জরুরি সেবাদানকারী সংস্থার ভবনও রেক্টোফিট করতে হবে। এছাড়া কমিউনিটি পিপলকে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে হবে। ফায়াস সার্ভিস শক্তিশালী করতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়। বিচ্ছিন্নভাবে প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপে রিসোর্সেরও অপচয় হতে পারে।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ভূমিকম্প ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তিন ধরনের করণীয় আছে। ভূমিকম্পের আগে করণীয়, ভূমিকম্পকালে করণীয় এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা। যদি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন বানানো হয় এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে এ দুটির কোনোটিই মানা হয় না।
তিনি বলেন, ভূমিকম্প বিষয়ে অনেক সাধারণ তথ্যই সাধারণ মানুষ জানে না। ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে এবং কী করা যাবে না- এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত ধারণা দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য ফায়ার সার্ভিসের কাছে নানা নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আছে। এসব ব্যবহারের জন্য এখন ঘন ঘন বিশেষায়িত মহড়া করতে হবে। - যুগান্তর
১৬ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস