রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ০৩:৫৬:৩০

'মেয়েটি এখন শুধুই স্মৃতি'

'মেয়েটি এখন শুধুই স্মৃতি'

রুদ্র মিজান : সেনানিবাস পর্ষদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাঈমা ইসলামকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ওই শিক্ষিকা গান ও নৃত্য শিক্ষা দেন নিজের ছাত্রীদের। নিজের ওই শিক্ষিকার মতোই শিল্পী ও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। স্বপ্নের পথেই হাঁটছিল সে। তার নাচ, গান ও কথার ভক্ত সবাই। ক্যাম্পাস মাতানো সেই মেয়েটি এখন শুধুই স্মৃতি। হন্তারক তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে নৃশংসভাবে।

বলছি সোহাগী জাহান তনুর কথা।

গত ২০শে মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুর থেকে যার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তনুকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল তার পিতামাতা ও ভাইদের। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তনু। পাঁচ সদস্যের এ পরিবারে টানাটানি থাকতো। তাতেও তনুর স্বপ্নে বাধা হননি পরিবারের কেউ। মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষকতা করার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল গান ও নৃত্যে জাতীয় পর্যায়ে সুনাম অর্জন করবে। কলেজ প্রথম হয়েছিল নৃত্যে। বিভাগীয় পর্যায়েও পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।

১৯৮০ সালে কুমিল্লার মুরাদনগরের মির্জাপুরের পূর্বপাড়ায় জন্ম তনুর। ইয়ার হোসেন ও আনোয়ারা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ও একমাত্র কন্যা তনু। পিতা ইয়ার হোসেন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক। তাই দুবছর বয়স থেকেই পরিবারের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস শুরু হয় তার। লেখাপড়ার হাতে খড়িও সেখানে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হাইস্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন তনু। পরে সেনানিবাস পর্ষদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন ইতিহাস বিভাগে।

ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার কারণে তার মেয়েটি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসা-যাওয়া করে এই নিয়ে ভয় ছিল পিতা ইয়ার হোসেনের। তনুর মাথায় হাত রেখে ইয়ার হোসেন জানতে চেয়েছিলেন- মাগো, তোমার কোনো সমস্যা হলে বাবাকে বলো। বাইরে আসা-যাওয়া করো- এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নাতো। তনু তখন হেসে হেসে বলেছিল, না আব্বা। কোনো সমস্যা হয় না। আমার ক্লাসমেটরা খুব ভালো। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করেছিলেন তনু। তনুর বিয়ের প্রস্তাব আসতো। তার পিতা তা ফিরিয়ে দিতেন। তিনিও চাইতেন মেয়েটি লেখাপড়া করে তার স্বপ্ন পূরণ করুক। সুনাম বৃদ্ধি করুক।

লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহের চাপ থেকে পিতাকে মুক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন তনু। তাই ২০১২ সাল থেকেই শুরু করেন টিউশনি। সেনানিবাস এলাকায় নিজেদের কোয়ার্টারে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন তনু। শেষ পর্যন্ত তিনটি টিউশনি ছিল। তাও সেনানিবাস এলাকার নিজেদের বাসা সংলগ্ন। ঘটনার দিন টিউশনি করতে বের হয়ে আর ফেরা হয়নি তনুর। প্রতিদিন রাত ১০টার দিকে বাসায় ফিরতেন তনুর পিতা ইয়ার হোসেন।

তনুর পিতা ইয়ার হোসেন জানান, তনু অপেক্ষায় থাকতেন পিতার সঙ্গে খাবেন। বাইসাইকেল চালিয়ে ইয়ার হোসেন বাসায় ফিরতেন। সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে যেতেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। একসঙ্গে খাবার খেতেন। আদুরে মেয়েটি নিজের হাতে বাবার মুখে ভাত তুলে দিতো। ইয়ার হোসেন বলেন, ওর হাতে এক দুবার না খেলে আমার ভাত খাওয়া হতো না। এখন আমাকে কে মুখে তুলে ভাত খাওয়াবে। আমার তনুকে আমি কোথায় পাব বলেন!

ঘটনার দিন টেইলার্স থেকে নতুন জামা আনতে বলেছিলেন মাকে। সেই জামা পরে ২৬শে মার্চ কলেজের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল তনুর। ওইদিন কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার তার হাতে তুলে দেয়ার কথা ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্যের। এই সম্মান অর্জনের দৃশ্য পিতামাতাকে সরাসরি দেখাতে চেয়েছিলেন তনু। পিতাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ইয়ার হোসেন ভীষণ আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ের এই সুনাম অর্জনের দৃশ্য তার মা দেখুক। ইয়ার হোসেন বলেছিলেন, তোর মাকে নিয়ে যা। তোর মা দেখুক তুই পুরস্কার পাচ্ছিস। সেই পুরস্কার নেয়া হয়নি তনুর। পরা হয়নি সেই জামা।

ইয়ার হোসেন জানান, স্বপ্ন পূরণ করার জন্য লেখাপড়া, নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি করছিলেন তনু। সেনাকল্যাণে প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে কম্পিউটারের নানা কাজ শিখেছিলেন। সেসঙ্গে নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত করতেন। হিজাব ব্যবহার করতেন তিনি। একমাত্র আদরের মেয়ে হত্যার বিচার চান এই পিতা।

ইয়ার হোসেন বলেন, মেয়ে অনার্স মাস্টার্স করে শিক্ষক হবে। সেসঙ্গে ভালো শিল্পী হবে। অনেক স্বপ্ন ছিল তার। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে ওরা। আমার মেয়েকে ওরা অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে। আমি বিচারের জন্য আর কত অপেক্ষা করব!-এম.জমিন
১৭এপ্রিল২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এএম

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে