সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:৩১:১৪

প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

মোহন রায়হান :  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বড় কষ্টে-বেদনায় আপনার উদ্দেশে এই নিরুপায় কলম তুলে নিয়েছি। আপনার সহপাঠী কবি নির্মলেন্দু গুণকে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি ঘটনার স্মরণে দুই টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে আপনি যে বদান্যতা দেখিয়েছেন, সেটাই আমাকে এই লেখার উৎসাহ জুগিয়েছে।

তা ছাড়া আপনার সঙ্গে একসময়ের প্রিয় সম্পর্কও এ লেখার প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। আপনার মহাখালীর কিংবা মিন্টো রোডের বাসায় মধুর আড্ডা, কবিতা উৎসব মঞ্চে পটুয়া কামরুল হাসানের ঢলে পড়া, আপনার গাড়িতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাংলা একাডেমির বইমেলায় বর্তমান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ বিরাট দলবল নিয়ে আমার স্টলে এসে অটোগ্রাফসহ আমার বই কেনা (যে বই আমি পরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের লাইব্রেরিতে পেয়েছিলাম), বিএনপি আমলে বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে বৈঠক শেষে আলাদা করে আমাকে ডেকে নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য কথা বলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরে সুধা সদনে আপনাকে দেখতে যাওয়া, বিটিভির জনতার আদালত অনুষ্ঠানে আপনার মুখোমুখি হওয়া— বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আপনার আমন্ত্রণে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া, কবিতা পড়া, প্রথমবার আপনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আপনার কার্যালয়ে কবিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে আপনার মধুর সান্নিধ্য, আপনার সঙ্গে এমন বেশকিছু অন্তরঙ্গ স্মৃতিও আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে এই লেখা লিখতে।

হ্যাঁ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একসময় আপনার সান্নিধ্যে ছোট ভাইয়ের মতো বড় বোনের কাছে যাওয়ার, মন খুলে কথা বলার সুযোগ ছিল আমাদের লেখক, কবি অনেকেরই। এখন রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে সেই সুযোগ নেই, ইচ্ছা করলেই মনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ আপনার কাছে তুলে ধরার বা প্রকাশ করার অবকাশ নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তৃতীয় বিশ্বের একজন অসহায় কবির ফরিয়াদ পৌঁছানোর উপায় হয়তো একমাত্র গণমাধ্যমই। আমার এই ফরিয়াদ আপনার কাছে আদৌ পৌঁছবে কিনা, এই লেখা আপনি পড়বেন কিনা, আপনাকে কেউ বলবে কিনা, আপনার টেবিলের দৈনন্দিন পেপার ক্লিপিংয়ে এর স্থান হবে কিনা জানি না। তবু বন্ধু কবি কামাল চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত পঙিক্তমালা’ কবিতার— ‘তুমি পড়বে না জানি তবু এই চিঠি পাঠিয়ে দিলাম’ স্মরণ করে এই লেখা লিখছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আমার বাড়ি জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কবি রজনীকান্ত সেন, ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন, গণিত সম্রাট যাদব চক্রবর্তী আর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত যমুনার পাড়ভাঙা মানুষের হাহাকারে বেজে ওঠা— সিরাজগঞ্জের খোকশাবাড়ী ইউনিয়নে।

আমার বাবা মরহুম ফরহাদ হোসেন, যিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন সৈনিক ছিলেন। নেতাজীর সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গেও ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। বাবার মুখে বহুবার শুনেছি, তরুণ তেজী বঙ্গবন্ধুর প্রতি সোহরাওয়ার্দীর গভীর আস্থা আর অসীম অনুরাগের কথা। বাবা ছিলেন তৎকালীন কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি শিয়ালদহ শাখার সাধারণ সম্পাদক। শিয়ালদহ বাস্তুহারা হকার্স মার্কেট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ভারত বিভাগের পর দেশে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মানুষের কাজে। নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খোকশাবাড়ী হাসপাতাল, কওমী জুট মিলস, ব্রাহ্মণবয়ড়া গ্রোয়েন বাঁধসহ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, নির্মাণ করেছিলেন রাস্তাঘাট, কালভার্ট ইত্যাদি। একটি অনুন্নত পশ্চাত্পদ এলাকার উন্নয়ন বলে যা বোঝায় তা তার হাতেই গোড়াপত্তন হয়েছিল। বলা যায়, একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে এমপি বা মন্ত্রীর কাজ করেছেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে মিলেছে জনগণের অসীম ভালোবাসা আর আজীবন চেয়ারম্যানের মুকুট। জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের পুরস্কার। তার মতো জনপ্রিয় চেয়ারম্যান এ দেশে হয়তো খুব কমই ছিল বা আছে। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের নমিনেশন প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সংগঠিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। ইউনিয়নে খুলেছিলেন চারটি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টার। সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়েই আমরা এলাকার যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।

আমার বড় ভাই মাহমুদ আলম মধু ছিলেন ভারতে সর্বোচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত অসম সাহসী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের শুরুতে রৌমারী ইয়ুথ ক্যাম্পের প্রথম প্রশিক্ষক। মিত্র বাহিনীর সঙ্গে থেকে বহু সম্মুখসমরে যিনি সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। ছিলেন বহু স্বর্ণপদক বিজয়ী জাতীয় অ্যাথলেট। ছিলেন নামকরা ফুটবলার। কিডনি এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে ঝরে গেছেন এই কৃতী সন্তান। আমার নিজের সম্পর্কে শুধু এইটুকু বলতে চাই— ১৯৬৬’র ছয় দফা আন্দোলনে হাফপ্যান্ট পরে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে সেই যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মিছিলে হাঁটা দিয়েছিলাম, আজও ঘরে ফিরিনি। ৬৬, ৬৯, ৭১, ৯০ স্বাধীনতাপূর্ব বা স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের এমন কোনো আন্দোলন সংগ্রাম নেই, আমি রাজপথে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলাম না। ভয়, ভীতি, জুলুম, অত্যাচার, কারাগার, অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতার কোনো লোভ-লালসার কাছেই আমি মাথা নত করিনি, আপস করিনি। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমার চেয়ে বেশি নির্যাতিত সম্ভবত আর কোনো ছাত্রনেতাই হয়নি। ১৯৮৩-এর ১১ জানুয়ারি। দেশ কাঁপানো সেই ছাত্র-বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী চোখ-হাত বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, নিখোঁজ বা গুম ছিলাম ২১ দিন। সামরিক টর্চার সেলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলা, বুট দিয়ে সারা শরীর থেঁতলে দেওয়া, লাথি, ঘুষি, চড়, থাপ্পড়, উপরে ঝুলিয়ে চাবুক দিয়ে মারা! সে কী নির্মম নৃশংস অমানবিক নির্যাতন। মনে হলে এখনো শিউরে উঠি! ভাবি কী করে সহ্য করেছিলাম সেই নিষ্ঠুর পাশবিকতা! কী করে এখনো বেঁচে আছি? হ্যাঁ, বেঁচে আছি, তবে পঙ্গুত্ববরণ করে। সেই অমানুষিক নির্যাতনে আমার মেরুদণ্ডের চার ও পাঁচ ডিক্স ডিসপ্লেস হয়েছিল। ২০০৬-এ চেন্নাই অ্যাপোলোতে অপারেশনের মাধ্যমে চলাফেরা করতে পারছি, তবে আমি কখনো উপুড় হতে পারি না, মেঝেতে বা নিচুতে বসতে পারি না, শক্ত বিছানায় শুধু চিত হয়ে আমাকে ঘুম বা বিশ্রাম নিতে হয়, এপাশ-ওপাশ করা নিষেধ, ভারী কিছু তুলতে পারি না, জোরে দৌড়াতেও পারি না— এক ধরনের পঙ্গুত্ব নিয়েই বেঁচে আছি। যত বয়স বাড়ছে জটিলতা বাড়ছে নির্যাতিত এই শরীরের। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দেশের সবচেয়ে বড় দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমার অগ্রণী ভূমিকা আশা করি সংশ্লিষ্টরা অস্বীকার করতে পারবেন না। আপনি নিজেও নিশ্চয়ই অনেক কিছুর খবর রাখেন।

আমার ছোট ভাই মনজুর রহমান বকুল, সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিল। ছিল জাসদ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক। ২০০৩-এ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আমার অন্য ভাইয়েরাও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এককথায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক একটি রাজনৈতিক পরিবার। আমাদের প্রয়াত বাবা, জীবিত মা, ভাইবোন প্রত্যেকে নীতি, আদর্শ, সততা এবং মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জনকল্যাণে নিবেদিত মানুষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

গত ৩১ মার্চ, সিরাজগঞ্জ সদর থানার ৫ নম্বর খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনের নামে এক নির্লজ্জ প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ওই নির্বাচনে সাবেক চেয়ারম্যান রাশিদুল হাসান (আওয়ামী লীগ), মোবারক হোসেন (বিএনপি), মনজুর রহমান বকুল (জাসদ) এবং রাজু আহমেদ (জামায়াত) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন এবং জাসদ ১৪ দলের শরিক দল হওয়ায় আমরা শুরুতে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইনি। ইউনিয়নবাসীর একান্ত অনুরোধেই আমরা এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। সত্যিকার অর্থেই তাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না গত পাঁচ বছরের বঞ্চনা ঘোচানোর। রাশিদুল হাসানের মনোনয়ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মোটেও পছন্দ করেননি। কারণ বিগত টার্মে চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন, দল কিংবা দলের নেতা-কর্মীদের কখনো কোনো মূল্যায়ন করেননি। বিশেষত তার নিজ গ্রামের মসজিদের টাকা, স্কুলের টাকা স্বাক্ষর-জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার ঘটনা এবং এলজিএসপি সংস্থার টাকা লুটপাটের মামলা ইত্যাদি কারণে দল এবং জনগণ সবার কাছে সে চরমভাবে নিন্দিত। জামায়াত-বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে ফকিরতলা বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ঘুষ নিয়ে রাশিদুল সেই মামলা থেকে বিএনপি-জামায়াতের আগুন-সন্ত্রাসীদের অব্যাহতির ব্যবস্থা করে দেয়। তার ভাইয়েরা, আত্মীয়স্বজন, অধিকাংশই জামায়াত-বিএনপি করে এবং তারাই তার কাছে প্রাধান্য পায় দলীয় কর্মীদের চেয়ে। ফলে দল থেকে তার এবার নমিনেশন পাওয়ার কথাই ছিল না। কিন্তু তৃণমূলের দলীয় ভোট কিনে নিয়ে সে নমিনেশন বাগায়। এতে মনোনয়নবঞ্চিত দলের যোগ্য নেতারা ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারাই আমাদের বার বার ফোন করে আওয়ামী লীগের বিকল্প ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে বকুলকে দাঁড় করিয়ে দেন। দলের জেলা শাখার চাপে তারা মাঝে-মধ্যে রাশিদুলের ক্যানভাসে নামলেও ভিতরে ভিতরে বকুলের পক্ষে কাজ করেন। কর্মীরা প্রকাশ্যে বকুলের জন্য মাঠে নামেন। গণজোয়ার সৃষ্টি হয় বকুলের। নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সবার মুখে বকুল, বকুল ধ্বনি ওঠে। যেখানেই গেছি মানুষের অভূতপূর্ব উচ্ছ্বাস। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে শঙ্কাও কাজ করছিল, আমরা ভোট দিতে পারব তো?’ আমি তাদের আশ্বস্ত করেছিলাম। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনার ঐতিহ্যবাহী দল। তারা রাশিদুলের মতো একজন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারীর জন্য জনগণের অধিকার হরণ করবে না। তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র ধ্বংসের দায় নেবে না। ভোট অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে। আমি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা এবং জেলার ডিসি-এসপির সঙ্গেও কথা বলি। তারা প্রত্যেকেই আমাকে কথা দিয়েছিল, ভোট সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। জনগণের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো।

সকাল ১০টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চলছিল। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের পক্ষে প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট প্রদান করছিল। এ অবস্থায় রাশিদুল হাসান দিশাহারা হয়ে পড়েন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শহর থেকে ভাড়া করা সন্ত্রাসী বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় একে একে তেলকুপি, চন্দ্রকোনা, বানিয়াগাঁতী, চরব্রাহ্মণগাঁতী ভোটকেন্দ্রে ঢুকে ফিল্মি কায়দায় প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ও অন্য প্রার্থীর এজেন্টদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে বের করে দিয়ে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে রাশিদুলকে এককভাবে ভোট প্রদান করে। খোকশাবাড়ী ইউপি সমাজকল্যাণ কেন্দ্রেও সকালে ১ ঘণ্টা বলপূর্বক ভোট হয় এবং সারাদিন বাইরে প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিবেশ শান্ত থাকলেও ভিতরে অন্য প্রার্থীদের এজেন্টকে ভয় দেখিয়ে প্রকাশ্যে রাশিদুলকে ভোট দিতে বাধ্য করে। নিস্তারিনী কেন্দ্রেও একই ঘটনা ঘটে। এখানে অন্য প্রার্থীদের এজেন্টরা বাধা প্রদান করলে তাদের ওপর হামলা হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি গুলি ছোড়ে এবং কিছুক্ষণ ভোট স্থগিত থাকে। চন্দ্রকোনা কেন্দ্রেও ২ ঘণ্টা ভোট স্থগিত থাকে। এভাবে মোট চারটি কেন্দ্রে তারা ভোট কেটে নেয় এবং দুটি কেন্দ্রে কারচুপির কৌশল বেছে নিয়ে আমাদের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়। অথচ যেসব কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে সেসব কেন্দ্রে আমরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছি এবং একটিতে দ্বিতীয় হয়েছি। ওই কেন্দ্রগুলোতে আমাদের সঙ্গে রাশিদুল হাসানের ভোটপ্রাপ্তির ব্যবধান আকাশ-পাতাল। ফলে এতকিছুর পরেও মোট ভোট গণনায় আমরা ৩২০ ভোটে জয়লাভ করি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ফলাফল ঘোষণা না করে শহরে উপজেলা নির্বাচন কমিশনে বাক্স নিয়ে এসে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দিয়ে গভীর রাতে রাশিদুল হাসানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, যা সর্বৈব মিথ্যা, সাজানো এবং ধোঁকাবাজি। জনগণের রায়ের কোনো প্রতিফলন এ ঘোষণায় নেই। এ ঘটনায় ইউনিয়নবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কান্নার রোল ওঠে প্রতিটি গ্রামে। মা-বোনেরা বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ভোটাররা বলে— ‘হায়! ভোট দিলাম কাকে আর জিতল কে?’ বর্ষীয়ানরা বলতে থাকেন— এ কোন যুগ এলো! কার চেয়ার কে কেড়ে নেয়? রাশিদুলকে মানুষ জুতা দেখিয়েছে, চোর চোর বলে ধিক্কার দিয়েছে!

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বকুল কমপক্ষে ৩ হাজার ভোটে বিজয়ী হতো। এলাকার জনগণ তাই এই প্রহসনের নির্বাচনের সাজানো ফলাফল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। গত ৩ এপ্রিল কয়েক হাজার নারী-পুরুষ এ ন্যক্কারজনক ভোট-ডাকাতির প্রতিবাদে ইউনিয়নব্যাপী প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ শেষে জেলা প্রশাসক বরাবর অপহৃত কেন্দ্রসমূহে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পুনর্নির্বাচনের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। নির্বাচনের দিন রাতে এলাকার জনগণ সঙ্গে নিয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে যখন জানতে পারলাম, এত ভোট-ডাকাতি, কারচুপির পরেও আমরা এগিয়ে আছি। তখন আমরা ফলাফল ঘোষণার দাবি জানালে, তারা টালবাহানা শুরু করলে আমরা ওইসব কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে তাত্ক্ষণিকভাবে রিটার্নিং অফিসার বরাবর আবেদন জানাই। আমাদের কাছে ভোট-ডাকাতির ভিডিও ফুটেজ, সংবাদপত্রের খবর, মৃত ব্যক্তি এবং অনুপস্থিত প্রবাসীদের ভোট প্রদানেরও ডকুমেন্ট রয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

কবি নির্মলেন্দু গুণ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হননি, কিন্তু আপনি তার যোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। গুণের মতো এত জনপ্রিয় কবি না হলেও কবি হিসেবে যৎসামান্য পরিচয় এবং এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমার এবং আমার পরিবারের ভূমিকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অত্যাচার-নির্যাতনভোগী জনযোদ্ধা হিসেবে সিরাজগঞ্জ খোকশাবাড়ী নির্বাচনে লুট হয়ে যাওয়া জনগণের স্বপ্ন ফিরিয়ে দিতে ভোট-ডাকাতির কেন্দ্রগুলোর পুনর্নির্বাচন কিংবা নিরপেক্ষ সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত বিজয়ীকে চেয়ারম্যান ঘোষণার ব্যবস্থা নিতে আপনার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

আপনি, বর্তমান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অসম সাহসী নেত্রী। আপনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা। পৃথিবীর সর্বহারা দুঃখী মানুষের একজন। সীমাহীন কষ্টের বিশাল পাহাড় বুকে নিয়ে কী ভীষণ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আপনার পথচলা... লড়াই, সংগ্রাম...। পিতা, মাতা, ভাই, ভ্রাতৃবধূ আর স্বজন হারানো এই বধ্যভূমির বেদনাশ্রু মোছাতে, সত্যিকার গণতন্ত্রের ফুল ফোটাতে, অনুগ্রহ করে সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রকৃত স্বরূপ সন্ধান করুন। কেননা, তৃণমূলই মুক্তিযুদ্ধের আঁতুড়ঘর। গণতন্ত্রচর্চার উর্বর জমিন। সেখানে এসিড ঢেলে নয়, খাঁটি জল ছড়িয়েই গণতন্ত্রের সবুজ গোলাপ ফোটাতে হবে।

আপনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার ডিপার্টমেন্টের বড় বোনও। আপনি লেখক, শিল্প-সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী ও উদার পৃষ্ঠপোষক এবং কবিতাপ্রিয়।— আশা করি এই বেদনাহত কবি এবং ছোট ভাইটির আবেদনে সাড়া দিয়ে আপনি আরেকটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবেন। পরিশেষে আপনার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করে আপনার হার্দিক উত্তরের বিনীত অপেক্ষায়...।-বিডি প্রতিদিন
১৮এপ্রিল২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে