নিউজ ডেস্ক : আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তখন উত্তাল সারা দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছিলেন খায়রুল কবির খোকন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের সামনে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ওই সময় জুনিয়র এক ছাত্রনেতা ইডেন কলেজের এক তরুণীকে এনে পরিচয় করিয়ে দেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন- আমি শিরিন সুলতানা। ছাত্রদলের রাজনীতি করতে চাই।
সাহসী শিরিনের বক্তব্য শুনে বিস্মিত হন খোকন। প্রথম দিনই তাকে ইডেন কলেজের মেয়েদের সংগঠিত করার এসাইনমেন্ট দেন। পরের দিনই শতাধিক মেয়ে নিয়ে হাজির হন। প্রথম এসাইনমেন্ট সফল হওয়ায় সবাই বাহবা দেন। এরপর একসঙ্গেই রাজপথে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন। আড্ডা দিতেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যেই ভালোলাগা জন্ম নেয়। একজন আরেকজনকে ভালো লাগলেও কেউ কোনদিন মুখে প্রকাশ করেননি। তবে খোকন ভালোবাসার বিষয়টি প্রকাশ করেন অনেকটা কূটনৈতিকভাবে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ডাকসুর নেতা হিসেবে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে দুটি আমন্ত্রণপত্র পান ‘মিস্টার খোকন ও মিসেস খোকন’ নামে। সেই সুযোগের পুরো ফায়দা লোটেন খোকন। শিরিনকে বঙ্গভবনের আমন্ত্রণের বিষয়টি জানান কৌশলে। গোপন রাখেন ‘মিসেস খোকন’ হিসেবে আমন্ত্রণের বিষয়টি। একই গাড়িতে করে শিরিনকে নিয়ে বঙ্গভবনে যান খোকন। তাদের দুজনকে একসঙ্গে উপস্থিত হতে দেখে অতিথিরা মুখ টিপে হাসাহাসি করেন। কিন্তু সেই হাসির নেপথ্য রহস্য বুঝতে পারেননি শিরিন। তখন বিএনপির সিনিয়র এক নেতা তাকে জিজ্ঞেস করেন- তুমি কোন পরিচয়ে, কার সঙ্গে এসেছো? তিনি উত্তর দেন- ‘আমি খোকন ভাইয়ের সঙ্গে এসেছি। হলের ভিপি হিসেবে।’ তখন তার ভুল ভাঙিয়ে দেন বিএনপির ওই নেতা। বলেন, তোমাকে ‘মিসেস খোকন’ বানিয়ে বঙ্গভবনে এনেছে খোকন। এরপর থেকেই তাদের প্রেমের বিষয়টি সবার মুখে মুখে চলে আসে। রাখঢাক করেননি তারাও। এরশাদের পতনের পরের বছর ১লা ফাল্গুন। ওইদিন বাসন্তি রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে দুজনই ডেটিং করতে যান চন্দ্রিমা উদ্যানে। ওই সময় ডেটিংয়ের একপর্যায়ে খোকনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন শিরিন। সায় দেন খোকনও। কিন্তু বাদ সাধে দুই পরিবার। খোকনের বাবাও ছাত্রনেত্রীকে ছেলের বউ করতে রাজি ছিলেন না। একইভাবে শিরিনের পরিবারও ছাত্রনেতার কাছে মেয়ে দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। ওই সময় তাদের প্রেমের সফল পরিণতি ঘটাতে এগিয়ে আসেন সহপাঠী তৎকালীন ছাত্রনেতারা। এমনকি বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পর্যন্ত গড়ায়। সব মহলের চাপে রাজি হয় দুই পরিবার। ১৯৯২ সালের ৮ই মে রাজধানীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। সংসার শুরু করেন রাজধানীর একটি ভাড়া বাসায়। পরের বছর তাদের কোলজুড়ে আসে এক পুত্র সন্তান। বর্তমানে একমাত্র ছেলে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
কাকতালীয় ঘটনা হলো- এই দুজনের পরিবারের কেউই রাজনীতি করতেন না। খোকনের বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সাবেক এই ছাত্রনেতার জন্ম ১৯৫৯ সালে নরসিংদীতে। এরপর প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন কাটে সেখানেই। ছাত্রজীবনে খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। তাই কলেজ জীবনে রাজনীতিতে সেভাবে জড়াননি। নরসিংদীর শহীদ আসাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চলে আসেন রাজধানীতে। ৮০-৮১ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ওঠেন মুহসীন হলে। ওই সময়ই সরাসরি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমেই ছাত্রদলের মুহসিন হল শাখার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পরে তাকে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ৮৫ সালের শুরুর দিকে কারাবরণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। গ্রেপ্তার করা হয় মুহসীন হলের মাঠ থেকে। কদিন পর ছাড়া পান। ৮৫ সালের শেষের দিকে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন রাজপথে জোরদারের কারণে ‘৯০ সালের ফেব্র“য়ারিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ফের গ্রেপ্তার হন খোকনও। ছ’মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পান। ওই বছরই ডাকসুর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদল থেকে আমান-খোকন-আলম প্যানেল মনোনীত হয়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হন।
এদিকে শিরিন সুলতানার পরিবারের কেউই রাজনীতি করতেন না। সাহসী এই ছাত্রনেত্রীর জন্ম ১৯৬৫ সালে রাজধানীর বাসাবোতে। বেড়ে ওঠেন সেখানেই। চার ভাই চার বোনের মধ্যে চতুর্থ শিরিনের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু বাসাবো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর বাবার চাকরি সুবাদে চলে আসেন মানিকগঞ্জে। সেখানকার সুরেন্দ্র কুমার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর ফের চলে আসেন রাজধানীতে। ৮২ সালে মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ইডেন কলেজে। চাকরিজীবী বাবার কড়া বারণ ছিল রাজনীতিতে না জড়ানোর। কিন্তু ডানপিটে শিরিনের রাজনীতির প্রতি ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। নেতৃত্বের গুণাবলীও ছিল প্রবল। মেয়ের এই গুণাবলীটি বুঝতে পেরেছিলেন মা ফৌজিয়া আক্তার। গোপনে মেয়েকে আর্থিক সহায়তা দিতেন। ৮৫ সালের দিকে ইডেন কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। ওই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য ছাত্রলীগের নেতারা প্রস্তাব দেয় শিরিনকে। কিন্তু টান ছিল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতি। ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে যোগাযোগ করেন মহল্লার বড় ভাইয়ের (ছাত্রদল নেতা) সঙ্গে। তিনি ইডেন কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। পরদিন ডাকসুতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন। সেখানে আলোচনার ভিত্তিতে ইডেন কলেজের ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে শিরিন-বাঁধন প্যানেল দেয়া হয়। তবে ওই নির্বাচনে হেরে যায় ছাত্রদলের প্যানেল। পরে ইডেন কলেজের সভাপতি নির্বাচিত হন শিরিন। এরপরই পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। নিয়মিত মিছিল-মিটিং করেন। রাজধানীর বিভিন্ন মহিলা কলেজ ছাত্রদলের কমিটি গঠন করে দেন। পরে ইডেন কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। উঠেন রোকেয়া হলে। পরে ওই হলের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ওই সময় ছাত্রদলের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে একমাত্র মেয়ে হিসেবে শিরিন সুলতানা সুযোগ পান। ৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির সব হল থেকে ছাত্রছাত্রী বের দেয় এরশাদ সরকার। শিরিনও চলে যান বাসায়। মহল্লার ছেলেদের সংগঠিত করে এলাকায় মিছিল করেন। একদিন বিকালে এলাকার ছেলেরা মিছিলের জন্য শিরিনের বাসায় নিচে এসে জড়ো হন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তার রাজনীতি-বিমুখ পিতা গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। উপায় না পেয়ে বাবাকে দোতলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেন শিরিন। পরে নিরুপায় বাবা গেটের তালা খুলে দেন। স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পতনের দিন আন্দোলনে ফিনিশিংয়ে নেতৃত্বে ছিলেন শিরিন। ওইদিন ভোরে কারফিউ ভেঙে শিরিন সুলতানার নেতৃত্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটি প্রতীকে পরিণত হয় বাঁশের লাঠি হাতে মিছিলের অগ্রভাগে শিরিনের ছবিটি। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের জমানায় অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন শিরিন। এরপর খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৯ (বাসাবো) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। পরে তাকে মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। মহিলা দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন শিরিন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে শিরিন সুলতানাও তিন মাস অবরুদ্ধ ছিলেন।-মানবজমিন
২৪ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ