সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৫১:৫১

পদ পদবিও হয় বেচাকেনা

পদ পদবিও হয় বেচাকেনা

নিউজ ডেস্ক: ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন আর জাতীয় নির্বাহী কমিটির পদ-পদবি নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে বিএনপিতে। নির্বাহী কমিটির তালিকা আসে নয়াপল্টনের কার্যালয় থেকে। আর তা অনুমোদন করেন গুলশান কার্যালয়ের ক্ষমতাধর এক কর্মকর্তা। অতঃপর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তা ঘোষণা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তিন দফায় ৪২টি গুরুত্বপূর্ণ পদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগেরই নাম জানেন না চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। উপেক্ষিত হয়েছে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেওয়া যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের নাম। সে স্থলে সম্প্রতি গড়ে ওঠা একটি ‘বাণিজ্য সিন্ডিকেটের’ দেওয়া তালিকার নামই ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে তারেক রহমান নিজেও অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ বলে লন্ডনের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছেন। অন্যদিকে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গড়ে ওঠা অপর একটি সিন্ডিকেটের সদস্যরা ইউপি নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। বছর দুয়েক আগেও যাদের বাসা ভাড়া দেওয়ার টাকা দিতে কষ্ট হতো তাদের অ্যাকাউন্টে এখন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়।

নিজেদের বড় বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পৌরসভা আর ইউপি নির্বাচনের মনোনয়ন ব্যবসার মাধ্যমেই ‘গুলশান সিন্ডিকেটের’ সদস্যরা অর্ধশত কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এই সিন্ডিকেটের ঘাঁটি বানিয়ে প্রতিদিনই দলের একজন সাবেক যুগ্ম মহাসচিবের বাসা থেকে পোলাও, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার সরবরাহ করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া যাদের বিশ্বাস করে দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন তারাই এখন ‘সরিষার ভেতরের ভূত’ এর মতো সেই কার্যালয়কে মনোনয়ন ও পদ-পদবি বিক্রির আখড়া বানিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বাণিজ্য সিন্ডিকেটের হোতারা সরাসরি টাকা না নিয়ে তাদের কয়েকজন এজেন্ট ও ‘ক্যাশিয়ার’ রয়েছেন, যাদের মাধ্যমে ‘মক্কেল’ ধরে টাকা-পয়সার লেনদেন করেন। দলের নতুন কমিটিতে পদ-পদবি দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন তারা। নিচ্ছেন দামি উপঢৌকনও। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সদ্য ঘোষিত দলের কয়েকটি যুগ্ম মহাসচিবসহ সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদের বেশ কয়েকটি পদ বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা পেয়েছে এই সিন্ডিকেট। আর পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্য করে ন্যূনতম অর্ধশত কোটি টাকা আয় করেন তারা। ইউপি নির্বাচনের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে নতুন নির্বাহী কমিটির পদ বাণিজ্য। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা সদ্য অবসর নেওয়া একজন যুগ্ম মহাসচিবের নেতৃত্বে গুলশান কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা এবং নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই পদ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তৃণমূল থেকে সুপারিশকৃত যে প্রার্থীর নাম গুলশান কার্যালয়ে আসে তারা নানা অজুহাত, ফাঁকফোকর বের করে তাদের নাম বাদ দিয়ে যারা নগদ টাকা দিতে পারেন, তাদের নামে মনোনয়নের চিঠি দেন। এমনকি বেশি টাকা পেলে দলের বাইরের অপরিচিত যে কোনো লোককেই দিয়ে দেওয়া হয় দলের প্রত্যয়নপত্র। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে প্রার্থী দিয়ে ৩০ লাখ টাকারও বেশি বাণিজ্য করেছে এই সিন্ডিকেট। দাউদকান্দির ইউনিয়ন নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে একজন প্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৬ লাখ টাকা। দলের নির্বাহী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলে চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, সিলেট, ঢাকার মিরপুর, এফডিসি এবং মিরেরসরাইয়ের অন্তত আটজনের কাছ থেকে এই সিন্ডিকেট বিরাট অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব নিয়ে এখন রীতিমতো তোলপাড় চলছে দলের ভিতরে। ফাঁস হয়ে গেছে এই সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ার বলে ‘পরিচিত’ এক নেতার ব্যাংকের স্টেটমেন্ট। দলের একজন সহদফতর সম্পাদকের গত এক বছরের একটি ব্যাংকের (মার্কেন্টাইল ব্যাংকে) হিসাব বিবরণীতে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে গত এক মাসে তিনি ৬১ বার লেনদেন করেছেন এই অ্যাকাউন্টে। এই ব্যাংক স্টেটমেন্টের ফটোকপি এখন বিএনপি নেতা-কর্মীদের হাতে হাতে। দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে গত বছরের ১৮ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রনেতাকে দলের গুরুত্বপূর্ণ সহদফতর সম্পাদক করারও অভিযোগ রয়েছে। তবে এই নেতার দাবি, এটি পুরোপুরিই তার ব্যবসার লেনদেনের টাকা। অথচ বছর খানেক আগেও বাসা কিংবা রিকশা ভাড়া দেওয়ার মতো টাকাও তার পকেটে থাকত না বলে জানান তার সহকর্মীরা। এরকম আরও কয়েকটি অ্যাকাউন্ট আছে গুলশান কার্যালয়ের ওই সিন্ডিকেট এবং তাদের এজেন্টদের। এ ছাড়াও বিএনপির এক নির্বাহী সদস্য ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া এলাকায় গত দুই মাসে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল নতুন দ্বিতল বাড়ি করেছেন এবং দুটি ট্রাক কিনেছেন। এর আগে তার বাড়িতে টিনের ঘর ছিল। আরেক নেতা কিনেছেন একটি ভক্সি গাড়ি। সম্প্রতি ঘোষিত দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদও বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার এই পদায়ন নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। ফেনী এলাকার অপর একজন বিএনপি নেতা। নামের শেষে মজুমদার উপাধি রয়েছে তার। তিনি রাজধানীর মিরপুরে থাকেন। তার কাছ থেকে নির্বাহী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তিসহ আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নের আশ্বাস দিয়ে নগদ ২৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে দলের স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্যও পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস পান না। তবে কোনো অনিয়ম বা অপকর্মে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে কিংবা বিপাকে পড়লে চেয়ারপারসনের নাম ভাঙিয়ে সেই বিপদের বৈতরণী পার করেন তারা। কোনো মিডিয়ায় এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের দুর্নীতি বা অপকর্মের কোনো সংবাদ পরিবেশিত হলে সেটিকে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেন এসব নেতারা। সম্প্রতি তিন দফায় দলের ৪২ জনের যে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তার বেশিরভাগ লোকের কাছ থেকেই কোনো না কোনো সুবিধা নিয়েছেন তারা। অথচ বেশিরভাগ ব্যক্তিকেই বেগম জিয়া চিনেন না। বাণিজ্য করে তাদের পদ-পদবি দেওয়া হয়েছে। হাইকমান্ড থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তা ওলট-পালট করে অর্থের বিনিময়ে নিজেদের লোকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন তারা। এসব অনিয়ম রুখতে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দলের বেশিরভাগ তরুণ এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। তাদের মতে, দলের নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় তারেক রহমান নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকলে এ ধরনের হীন পদবাণিজ্য করতে পারত না গুলশানের এই সিন্ডিকেট।-বিডি প্রতিদিনি

২৫ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে