মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:৫৬:৩৩

যেভাবে খুন করা হয় জুলহাস মান্নানকে

যেভাবে খুন করা হয় জুলহাস মান্নানকে

নিউজ ডেস্ক : এবার ঢাকায় অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের হামলায় সমকামীদের প্রথম পত্রিকা রূপবানের এক সম্পাদক জুলহাস মান্নানসহ দু’ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।  এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো তিনজন। ২৫ এপ্রিল সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে।  নিহতদের নাম জুলহাস মান্নান ও তন্ময় মজুমদার।  তারা দু’জন সম্পর্কে বন্ধু বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, কলাবাগান থানাধীন লেকসার্কাস এলাকার ৩৫ নম্বর উত্তর ধানমন্ডির নিজেদের বাড়ির দোতলায় থাকতেন জুলহাজ মান্নান। সাত তলা ওই বাড়ির নিচতলায় পারভেজ মোল্লা নামে একজন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করছিলেন। গতকাল বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে ৫-৬ যুবক দুটি পার্সেল নিয়ে ওই বাসায় যায়। তারা বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীকে জুলহাজ মান্নানের নামে পার্সেলগুলো এসেছে বলে জানায়।

এরপর দারোয়ান তাদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে দোতলায় উঠলে ওই যুবকরাও দোতলায় উঠে যায়। এ সময় দরজা খুলে জুলহাজ মান্নান বেরিয়ে এলে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় আঘাত করা হয়। জুলহাজ দৌড়ে ভেতরে ঢুকতেই দুর্বৃত্তরাও তার সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। বাসার ড্রয়িং রুমে জুলহাজের মাথায় এলোপাথাড়ি কুপিয়ে আঘাত করে। ভেতরের ঘরে তন্ময় নামে জুলহাজের এক বন্ধু ছিলেন। চিৎকার শুনে তিনি এগিয়ে এলে তাকেও এলোপাথাড়ি কুপিয়ে আহত করে হামলাকারীরা। এদিকে বাসার দারোয়ান পারভেজ বাধা সৃষ্টি করতে চাইলে তাকেও কোপায় তারা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্বৃত্তরা বাসা থেকে বেরিয়ে পাশের মসজিদ গলি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। সেখানে আগে থেকেই টহলে থাকা একটি পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। চিৎকার শুনে পুলিশ ওই যুবকদের আটকানোর চেষ্টা করলে তারা পুলিশের ওপরও হামলা চালায়। এতে এএসআই মমতাজ নামে এক পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে পুলিশ ফাঁকা গুলি করলেও দুর্বৃত্তদের কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশ জানায়, ঘটনার পরপরই আহত দারোয়ান পারভেজ মোল্লাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পুলিশ সদস্য মমতাজকে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় কয়েক যুবকও তাদের ধাওয়া করে। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন লিঙ্কন নামে এক যুবকের হাতে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আনোয়ার আইডিয়াল কমার্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওই বাসায় দুজনকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। তারা জিন্সের প্যান্ট ও আকাশী এবং ছাই রঙের শার্ট পড়ে এসেছিল। প্রত্যেকের কাঁধে একটি করে ব্যাগ ছিল। একজনের হাতে অস্ত্র দেখেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় নারী।

ওই বাসার দারোয়ান পারভেজ জানান, জুলহাজ দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। একই সময় তার ওপরও হামলা করা হয়। তিনি চিৎকার করতে থাকেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে দুর্বৃত্তরা বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, বাসার ড্রয়িং রুমের মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল জুলহাজের দেহ। তার মাথায় অনেকগুলো কোপ ছিল। শয়ন কক্ষে পড়ে ছিল তন্ময়ের লাশ। ওই বাসায় জুলহাজের বৃদ্ধ মা ও কাজের মেয়ে ছিলেন। তারা রান্না ঘরে ছিলেন।

যে দুটি বাক্স নিয়ে তারা প্রবেশ করেছিল তাতে কাগজ ও ডাবের খোসা ভরা ছিল। হামলাকারীদের সঙ্গে রাখা ব্যাগে চাপাতি ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বাসিন্দারা চিৎকারের শব্ধ শুনে বের হতে চাইলেও বাইরে থেকে দুর্বৃত্তরা দরজায় লাথি দেয়ায় তারা বের হতে পারেননি।

এদিকে বাসার ভেতরে ডাবল মার্ডারের খবর পেয়ে র‌্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ভিড় জমে কৌতূহলি মানুষেরও। সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম, সাবেক পররারাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণিসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, কিলিং মিশনে ছয়জন অংশ নিয়েছিল। তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তারা কারা, কেন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা তদন্ত করে বের করা হবে।

হত্যার ধরন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, উগ্রপন্থি কোনো গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নিহত জুলহাজ মান্নান সমকামীদের সমর্থন ও তাদের নিয়ে কাজ করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত পয়লা বৈশাখের মঙ্গলশোভা যাত্রায় জুলহাজ মান্নানের নেতৃত্বে সমকামীদের একটি র‌্যালি যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। পয়লা বৈশাখের দিন জুলহাজকে শাহবাগ থানা পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

নিহত জুলহাজের স্বজনরা জানান, জুলহাজের বাবার নাম মৃত আবদুল মান্নান। তিনি উপ-সচিব ছিলেন। মায়ের নাম সকিনা বেগম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে জুলহাজ ছিলেন মেজো। বড় ভাই ইমন গুলশানে থাকেন। আর একমাত্র বোন থাকেন আমেরিকায়। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তির নরিংপুর এলাকায়।

ইউএসএআইডি’র কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ঢাকার সদ্য সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রোটকল অফিসার হিসাবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এদিকে জুলহাজের বিষয়ে তথ্য জানা গেলেও তার বন্ধু তন্ময়ের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানা যায়নি। তন্ময় ঢাকার একটি নাট্যদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তথ্যসূত্র : এমজমিন

২৬ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে