মাহমুদুল হাসান: দলীয় পদ বণ্টন এবং পৌরসভা ও ইউনয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন পাইয়ে দিতে সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ ঘুষ গ্রহণ করেছেন- এমন খবরে তোলপাড় চলছে বিএনপিতে। এসব অভিযোগের প্রমাণ এখন বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়ার হাতে। বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ তিনি।
এ ঘটনায় দলের আস্থাভাজন নেতাদের ওপর খালেদা জিয়ার আস্থায় চিড় ধরেছে। এমতাবস্থায় দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও অসন্তোষ দূর করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লন্ডনে চিকিৎসাধীন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী নেতাদের উপর। তার সরাসরি হস্তক্ষেপ ও নির্দেশনায় ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ড অভিযুক্তদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করেছে। পদ বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সরাসরি যাদের নাম এসেছে এবং যারা এ প্রক্রিয়ায় সঙ্গে জড়িত তাদের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বেলাল আহমেদসহ দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের বিরুদ্ধেও পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও লেখালেখি হয়েছে।
‘নেতার ব্যাংক স্টেটমেন্টে বিএনপিতে তোলপাড়’ এই শিরোনামে গত শনিবার(২৩ এপ্রিল) এক সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক কালের কণ্ঠ। সংবাদে বলা হয়, ‘‘দলের সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর একটি ব্যাংক স্টেটমেন্টকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে এখন তোলপাড় চলছে। গত এক বছরে সংশ্লিষ্ট ওই নেতা মার্কেন্টাইল ব্যাংকে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। দলীয় বিরোধীদের অভিযোগ, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ওই লেনদেন হয়েছে। অন্যদিকে তাইফুল সমর্থকরা এ ঘটনাকে দলের একাংশের নোংরামি বলে অভিহিত করছেন। তাদের মতে, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ‘লোক’ হওয়ায় তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “গত বছর গঠনতন্ত্রে পদ শূন্য না থাকা সত্ত্বেও নতুন একটি পদ সৃষ্টি করে এই তাইফুলকে সহদপ্তর সম্পাদক করা হয়েছে। মোহাম্মদ শাহজাহানসহ অনেকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে আলোচনা থাকলেও তাকে পদায়নের নেপথ্যে শিমুল বিশ্বাসের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে বলে দলের অনেক নেতার অভিযোগ। যদিও শিমুল বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তিনি কাউকে নিয়োগ বা পদায়ন করেননি। তাকে পদায়ন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
এছাড়া ‘বিএনপিতে মনোনয়ন বাণিজ্য সিণ্ডিকেট’ এ শিরোনামে ইত্তেফাক (২৪ এপ্রিল) একটি সংবাদ প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিএনপিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন এবং দলের পদ-পদবি বিক্রির একটি বাণিজ্য সিন্ডিকেট বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ছে। চেয়ারপার্সনের গুলশান অফিসে এই সিন্ডিকেটের ঘাঁটি। বেগম খালেদা জিয়া যাদের বিশ্বাস করে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন তারাই এখন তার অফিসকে ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ করে নিয়েছেন এ যেন সরিষার ভেতরেই ‘ভূত’। এই বাণিজ্য সিন্ডিকেটের হোতারা সরাসরি টাকা নেন না। তাদের কয়েকজন এজেন্ট আছেন যারা ‘ক্যাশিয়ার’ ও ‘মক্কেল’ ধরার কাজ করেন। তারাই ইউপিতে প্রার্থী মনোনয়নে রমরমা বাণিজ্য করছেন। এর আগে পৌর নির্বাচনেও করেছেন। দলের নতুন কমিটিতে পদ-পদবি দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বড় অংকের টাকা নিচ্ছেন তারা। নিচ্ছেন উপঢৌকন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “ঐ সিন্ডিকেটের অভ্যন্তরের এক সূত্র জানায়, সদ্য ঘোষিত সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদের কয়েকটি বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা পেয়েছে এই সিন্ডিকেট। আর পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্য করে অন্তত ৩০ কোটি টাকা আয় করেছেন তারা। এখন ইউপি নির্বাচনের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন কমিটির পদ বাণিজ্য। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা সদ্য অবসর নেয়া এক যুগ্ম মহাসচিব। তার সঙ্গে আছেন গুলশান অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা এবং স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য। স্থানীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে হলে বেশিরভাগ প্রার্থীকে গুনতে হয় নগদ টাকা। এজন্য এই সিন্ডিকেট ফাঁদ পাতে। তৃণমূল থেকে সুপারিশকৃত যে প্রার্থীর নাম গুলশান অফিসে আসে তারা নানা অজুহাত, ফাঁকফোকর বের করে। এতকিছুতে প্রার্থী যখন পেরেশান হয়ে পড়েন তখন সিন্ডিকেটের এজেন্টরা দরদাম করতে থাকে। শেষে রফা হয়। আবার বেশি টাকা পেলে অপরিচিত কোনো লোককে দেয়া হয় দলের প্রত্যয়নপত্র।”
‘ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান’ বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে (২৫ এপ্রিল) গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কার্যালয়ভিত্তিক কয়েকজন দলীয় নেতার কর্মকাণ্ডে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিশেষ করে দলের নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনে ‘পদ-বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের কারণে চরম অসন্তুষ্ট তারেক রহমান। কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হাতে গোনা তিন-চারজন নেতার প্রতি তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট বলে লন্ডনের একটি সূত্র গতকাল জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে (ইউপি) ‘মনোনয়ন বাণিজ্যে’র সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গতকাল ইউপি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস করা হয়েছে বলে চেয়ারপারসন কার্যালয়ের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তবে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানতে নারাজ বেলাল আহমেদ। সোমবার (২৫ এপ্রিল) রাতে তিনি বলেন, ‘এগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হচ্ছে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। তাই বলে একজনের বিরুদ্ধে নোংরা খেলায় মেতে উঠতে হবে -এটা কাম্য নয়।’
এদিকে বিগত কয়েকবছর ধরে সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য দায়িত্বশীল একজন যুগ্ম-মহাসচিবের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। দলের ভেতরে-বাইরে আলোচনা চলছে। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে দলটির হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ হয়ে পৌরসভা নির্বাচনের শেষ ধাপে তাকে মনোনয়ন প্রত্যয়ণের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে -এমনটাও বলছেন কেউ কেউ।
জানা গেছে, এখন থেকে মনোনয়ন প্রত্যয়ন করবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই সংক্রান্ত একটি চিঠি সোমবার নির্বাচন কমিশনে দিয়ে আসেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল কবির সোমবার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে ৫ দিনের মধ্যে নমুনা স্বাক্ষর কে করবেন তার নাম চাওয়া হয়েছে। এই সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছি, অন্য কিছু নয়।’
তিনি বলেন, ‘মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) জেলে থাকার সময় শাহজাহান ভাই (সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান) স্বাক্ষর করেছেন। মহাসচিব জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে তিনি স্বাক্ষর করছেন।’
এদিকে সোমবার বিকালে বিএনপি কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চলমান ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মো: শাহজাহানকে নির্বাচন মনিটরিং ও পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মর্মে কিছু কিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। মহল বিশেষ হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এ ধরনের সংবাদ প্রচার করছে। বিএনপির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মো: শাহজাহান এখনও ইউপি ও পৌর নির্বাচন মনিটরিং ও পরিচালনার দায়িত্বে বহাল আছেন। তাকে অব্যাহতি দেয়ার সংবাদ সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও কাল্পনিক।’
‘আগামী ৯টি পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পূর্বের মতোই প্রত্যয়ন করবেন দলের মহাসচিব। নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী দলের মহাসচিব মহোদয়ের নমূনা স্বাক্ষরটি ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে’ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর আর আমাদের কথা বলার অধিকার থাকে না। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন।’
দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন এক নেতার সঙ্গে কথা বললে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আসলে এসব বিষয়ে কথা বলতে ঘৃণা হয়। ম্যাডাম(খালেদা জিয়া) সব বিষয়ে অবগত আছেন, তিনিই ব্যবস্থা নেবেন।’
২৭ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ