নুরুজ্জামান লাবু ও রুদ্র মিজান : জোড়া খুনের ঘটনার আগে দুপুরে রেকি করে গিয়েছিল ঘাতকরা। পার্সেল পৌঁছে দেয়ার নামে দুপুরে কলাবাগানের বাসার ফটকে গিয়ে জুলহাজ মান্নান বাসায় আছেন কিনা তা জানতে চেয়েছিল নিরাপত্তারক্ষীর কাছে। ওই সময় তিনি বাসায় নেই জেনে তারা ফিরে যায়। পরে সন্ধ্যায় এসে তাদের মিশন সফল করে। ওদিকে বিশ্বব্যাপী আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে আটসাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। থানা পুলিশের পাশাপাশি, ডিবি পুলিশ, কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট, র্যাব, পিবিআই, সিআইডিসহ বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও মাঠে নেমেছে। এক ঘাতকের ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন ও পিস্তলসহ অন্যান্য আলামত ঘিরে চলছে তদন্ত। পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের আগে একাধিকবার ঘটনাস্থল রেকি করেছে খুনিরা। এছাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খুনের সঙ্গে জোড়া খুনের ধরনের মিল রয়েছে বলেও জানান তিনি। এদিকে জুলহাজ ও তনয় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) কথিত বাংলাদেশ শাখা ‘আনসার আল ইসলাম’। অপরদিকে দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশের তদন্তে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলেছেন, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মাথার ক্ষত এতটাই গভীর ছিল যে, ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। ডাবল মার্ডারের ঘটনায় কলাবাগান থানায় নিহত জুলহাজের ভাই ও পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বইছে।
সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় রাজধানীর কলাবাগানের ৩৫, উত্তর ধানমন্ডির আছিয়া নিবাসের দ্বিতীয় তলায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএস এইডের বর্তমান ও ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান (৪২) ও তার বন্ধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহবুব রাব্বী তনয় (২৫)কে। জুলহাজ সমকামীদের অধিকারবিষয়ক সাময়িকী ‘রূপবান’-এর সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর লোকনাট্য দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন মাহবুব তনয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে এসব খুন করা হচ্ছে। সব খুনের শেকড়ই এক উল্লেখ করে তিনি বলেন, কখনও শিবির, কখনও জেএমবি, কখনও আনসারুল্লাহর নামে এসব করা হচ্ছে। তারা সবাই সন্ত্রাসী। এসব খুনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ঘটনা ঘটছে। তার তুলনায় বাংলাদেশে সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ডাবল মার্ডারের আপডেট প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এখনও বলার মতো সময় আসেনি। কিছু আলামত হত্যাকারীরা রেখে গেছে, প্রত্যক্ষদর্শীও রয়েছে। তদন্ত করে বিষয়টি জানা যাবে। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেছেন, এটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ধারণা করছি, রেকি করে খুনিরা খুনের পরিকল্পনা করেছে। শনিবার রাজশাহীতে খুন হওয়া অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জোড়া খুনের ঘটনার ধরনের মিল রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশের এক সদস্য এক ঘাতককে জাপটে ধরেছিলেন। সেসময় তার অন্য সহযোগীরা পুলিশকে কুপিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। তবে ঘাতকরা এসময় নিজেদের একটি ব্যাগ ফেলে যায়। পুলিশ ওই ব্যাগ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন, গুলি, গোলাকৃতির আগ্নেয়াস্ত্র, চাপাতি, লাল চেক গামছা, পুরনো লুঙ্গি, কাপড়ের টুপি, বাংলা ও আরবি লেখা সাদা কাগজের টুকরো উদ্ধার করেছে। তবে ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে যাওয়া ডিএমপি কমিশনার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধারের কথা বলেছিলেন। তবে সোমবার গভীর রাতে দায়ের করা মামলার জব্দ তালিকায় মোবাইল ফোনের কথা উল্লেখ নেই। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অনেক আলামতই পুলিশের হাতে রয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোন ও পিস্তল থেকে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা সহজ হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইলটি কোথায় কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে পুলিশ জানতে পারবে। এতে খুনিদের শনাক্ত করা সহজ হবে। উদ্ধার হওয়া পিস্তল কোথা থেকে এসেছে। এটা কেনা নাকি ভাড়া করে নেয়া সে সম্পর্কে পুলিশ তথ্য উদ্ধার করতে পারলে তদন্তে কাজে লাগবে। এছাড়া, উদ্ধার হওয়া আলামত থেকে খুনিদের হাতের ছাপ পাওয়া যাবে। এতে খুনিদের শনাক্ত করা সহজ হতে পারে বলে জানান তিনি।
সিসিটিভিতে অস্পষ্ট ছবি: ডাবল মার্ডারের ঘটনার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা ঘটনাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ক্যামেরা রাস্তা কভার করায় সন্দেহভাজন কিলারদের দেখা গেছে। কিন্তু দূর থেকে চিত্রগ্রহণ হওয়া এবং দুর্বল রেজ্যুলেশন হওয়ার কারণে ঘাতকদের স্পষ্ট কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, একটি সিসিটিভি ফুটেজে ৪-৫ জনকে স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুতগতিতে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু ছবিগুলো তুলনামূলক অস্পষ্ট। সেগুলো পরিষ্কার করে মুখের অবয়বগুলো সাজানোর চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সিসিটিভির ফুটেজগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্লিন করলে খুনিদের চেহারার কিছু ছাপ পাওয়া যাবে। যা তাদের শনাক্তে সহায়ক হবে বলে জানান তিনি।দুপুরেও পার্সেল নিয়ে এসেছিল ঘাতকরা: হত্যার আগে দুপুরেও একবার পার্সেল নিয়ে জুলহাজ মান্নানের খোঁজে তার বাসায় গিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা। এসময় জুলহাজ বাসায় ছিলেন না। তাকে না পেয়ে ফিরে যায় ঘাতকরা। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ির প্রহরী পারভেজ মোল্লার বরাত দিয়ে জুলহাজের চাচা আমিরুল ইসলাম জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা। তারা জানতে চেয়েছিলো, জুলহাজ বাসায় আছেন কি-না? কেন জানতে চাইলে তারা বলেছিলো, তার নামে পার্সেল এসেছে। আমরা পার্সেল দিতে এসেছি। পারভেজ বলেছিলেন, আমার কাছে দিয়ে যান। তারা জানায়, হাতে হাতে বিলি করতে হবে। জুলহাজ ছাড়া অন্য কারও কাছে দেয়া যাবে না। পরে জুলহাজ বাসায় নেই জানানোর পরে তারা গেইটের বাইরে থেকে চলে যায়। পারভেজের বরাত দিয়ে আমিরুল ইসলাম জানান, তিন যুবক গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে পারভেজের সঙ্গে কথা বলেছিলো। তাদের হাতে দুটি বাক্স ছিলো। ওই যুবকরাই পরবর্তীতে বাসায় গিয়ে জুলহাজ ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত। একারণে অনেক আগে থেকেই ঘাতকরা হয়তো জুলহাজের ওপর নজরদারি করছিলো। তার বাসা কোথায়, কখন বাসায় ফেরে, কখন বের হয় এসব তথ্য সংগ্রহ করে থাকতে পারে। তা না হলে আবাসিক এলাকায় দুজন মানুষকে হত্যার পর নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পুরো বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ চলছে।
পৃথক দুই মামলা: ডাবল মার্ডারের ঘটনায় নিহত জুলহাজের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন বাদী হয়ে সোমবার গভীর রাতে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা (নং ৮) দায়ের করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া কলাবাগান থানার এসআই শামীম বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে ও পুলিশের ওপর হামলা করায় পৃথক একটি মামলা (নং ৯) দায়ের করেন। নিহত জুলহাজের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন এজাহারে বলেছেন, সোমবার বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে অফিস থেকে তার ভাই জুলহাজ ও তার বন্ধু তনয় বাসায় ফেরেন। তারা বাসায় ঢোকার ১০ মিনিট পর ৫/৬ জন লোক একই রকম টি-শার্ট ও কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো অবস্থায় বাসায় ঢুকে। পার্সেল ডেলিভারির কথা বলে বাসায় ঢুকে তারা তার ভাই ও ভাইয়ের বন্ধুকে এলোপাতাড়ি কোপায়। এসময় তার মা সখিনা খাতুন ও কাজের মেয়ে রেশমা (২৫) দরজা বন্ধ করে অন্য রুমে ছিল। জুলহাজকে ডাইনিং রুমে এবং তনয়কে জুলহাজের বেডরুমে কুপিয়ে ফেলে রেখে মেইন গেট দিয়ে ঘাতকরা পালিয়ে যায়। দারোয়ান বাধা দিলে তাকেও আঘাত করা হয়। কলাবাগান থানার এসআই শামীম বাদী হয়ে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, কলাবাগানের রাশেদ মোশারফের বাসার সামনে পাঁচ-ছয়জন সন্দেহভাজন যুবককে চ্যালেঞ্জ করে পুলিশ। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ব্যাগ ছিল। গায়ে ছিল একই রঙের টি-শার্ট। পুলিশের গাড়ির মুখোমুখি হওয়ার পর গাড়ি থামিয়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের ধরতে যায়। একপর্যায়ে এএসআই মমতাজ একজন দুর্বৃত্তকে জাপটে ধরে ফেলেন।
কিন্তু তাৎক্ষণিক তার সহযোগী একজন মমতাজকে চাপাতি দিয়ে কোপ দিলে তিনি পড়ে যান। দুর্বৃত্তরা তাকে আবারও কোপাতে গেলে এসআই শামীম নিজে তার পিস্তল দিয়ে এক রাউন্ড গুলি করেন। কনস্টেবল নূরুল ইসলামও শটগান দিয়ে এক রাউন্ড গুলি করেন। এসময় দুর্বৃত্তদের একজন পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসআই শামীম দৌড়ে আরেকজন দুর্বৃত্তকে জাপটে ধরলে সে সঙ্গের ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যায়। ওই ব্যাগ থেকে মেড ইন ইউএসএ লেখা ৭.৬৫ বোরের পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন, চাবির রিংসহ আরেকটি পিস্তল ও ব্যারেলে দুই রাউন্ড গুলি, একটি চাপাতি, একটি লাল চেক গামছা, পুরনো লুঙ্গি, কাপড়ের টুপি, বাংলা ও আরবি লেখা সাদা কাগজের টুকরো উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, দুর্বৃত্তদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তির স্থান থেকে দুটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়েছে। ফোন দুটির ভেতরের সবকিছু যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, এগুলো দুর্বৃত্তদের মোবাইল ফোন। এর ভেতর থেকে অনেক ক্লু উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে।
প্রশিক্ষিত গোষ্ঠীর কাজ: নিহত দুজনের লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক চিকিৎসকরা। ডাবল মার্ডারের সঙ্গে ব্লগার হত্যার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। মঙ্গলবার দুপুরে নিহত ব্যক্তিদের ময়নাতদন্ত শেষে ঢামেক মর্গের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, নিহতদের মাথায়, মাল্টিপল চপ (বেশকিছু কোপানোর চিহ্ন) ছিল। যা ধারালো অস্ত্রের আঘাত। ভারী ধারালো অস্ত্রের আঘাতের কারণে মারা গেছেন তারা। ময়নাতদন্তকারী এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, তারা টোটালি প্রশিক্ষিত একটা গোষ্ঠী। যারা টার্গেট করে আসছে যে আমাকে এ জায়গাটাতে মারতে হবে। তারা একই জায়গায় মেরেছে।’ সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘এ ধরনের আঘাতের পর কারও বেঁচে যাওয়া সম্ভব নয়। একই স্থানে উপর্যুপরি কয়েকটি আঘাত ছিল, সেই আঘাত মাথার খুলি কেটে মগজ পর্যন্ত পৌঁছেছে। তনয়ের স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে গেছে।
যা আছে সুরতহালে: জুলহাজ ও তনয়ের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনছার আলী। জুলহাজের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলহাজের মাথার পেছনের বাম দিকে ছয় ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি পরিমাণ পরিধি নিয়ে কয়েকটি আঘাত রয়েছে। মাথার ওই অংশের খুলি কেটে মগজ বের হয়ে গেছে। মাথার পেছনের ডান অংশে কানের উপরে দুই থেকে তিন ইঞ্চি চামড়া এবং খুলিসহ কেটে ঝুলে গেছে। তার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি, হাতের মধ্যভাগ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেটে গেছে। লাশটি বাসার ডাইনিং রুমে উত্তর শিয়রি অবস্থায় পাওয়া গেছে। মৃত জুলহাজ মান্নানের বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। গায়ের রং ফর্সা। পরনে ছিলো হলুদ-কালো রঙ্গের শর্ট প্যান্ট ও ছাই রঙের হাতকাটা গেঞ্জি বলে সুরতহালে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে খন্দকার মাহবুব রাব্বী তনয়ের লাশের সুরতহালে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মাথার পেছনের অংশ গর্দানসহ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রায় এক ফুট পরিমাণ কেটে গেছে। কাটাস্থানের প্রস্থ তিন ইঞ্চি, গভীরতা প্রায় চার ইঞ্চি। মাথার উপরিভাগে তালুতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রায় পাঁচ ইঞ্চি পরিমাণ দৈর্ঘ্য ও এক ইঞ্চি পরিমাণ গভীরতায় খুলিসহ কেটে মগজ বের হয়ে গেছে। তনয়ের লাশটি জুলহাজের বেডরুমের পশ্চিম কোনে মেঝেতে উপুড় হয়ে ছিলো। তার বয়স প্রায় ২৫ বছর। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা। চুল লম্বা। পরনে ছিলো নীল রঙের প্যান্ট ও কালো রঙের টিশার্ট।
আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকার: হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) কথিত বাংলাদেশ শাখা ‘আনসার আল ইসলাম’। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে আনসার আল ইসলামের নামে খোলা টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এই দায় স্বীকারের বার্তা প্রচার করা হয়। বাংলা ও ইংরেজিতে দেয়া টুইট বার্তায় আনসার আল ইসলামের ‘দুঃসাহসী মুজাহিদীনরা’ সমকামীদের গুপ্ত সংগঠন ‘রূপবান’-এর পরিচালক জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু সামির মাহবুব তনয়কে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
বনানীতে জুলহাজের দাফন, মিরপুরে তনয়ের: গতকাল বেলা ১২টার দিকে নিহত জুলহাজ মান্নান ও মাহাবুব তনয়ের লাশ তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জুলহাজ মান্নানের লাশ গ্রহণ করেন তার চাচা আমিরুল ইসলাম। হাসপাতাল মর্গ থেকে জুলহাজের লাশ উত্তর ধানমণ্ডির বাসায় নেয়া হয়। বাদ জোহর স্থানীয় তেঁতুলতলা মাঠে জানাজা শেষে তার লাশ নেয়া হয় বারিধারায় আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে। পরে বিকালে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় জুলহাজকে। জুলহাজের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, তার ভাইয়ের এমনিতেই কোনো শত্রু ছিল বলে তার জানা নেই। সে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতো। একারণে হয়তো তাকে টার্গেট করা হয়েছে। মিনহাজ বলেন, জুলহাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন। এরপর থেকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেছেন। সর্বশেষ ইউএসএইডে কর্মরত ছিলেন। জুলহাজের স্বজনরা জানান, উত্তর ধানমণ্ডির বাসায় জুলহাজ ও তার মা থাকতেন। হত্যাকাণ্ডের পর বৃদ্ধা মাকে গুলশানে বড় ছেলের বাসায় নেয়া হয়েছে। বাসাটি বর্তমানে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এদিকে দুপুর ১টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে তনয়ের লাশ গ্রহণ করেন ফজলুর রহমান। এসময় তনয়ের দুই মামাও ঢামেক হাসপাতালের মর্গে উপস্থিত ছিলেন। তনয়ের লাশ বিকাল ৪টার দিকে শিল্পকলা একাডেমিতে নেয়া হয়। সেখানে তনয়ের নিজের দল লোকনাট্য দলের সহকর্মীসহ নাট্যকর্মীরা তার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সেখানে প্রথম জানাজা শেষে শেওড়াপাড়ার বাসায় নেয়া হয় লাশ। সেখানকার স্থানীয় মসজিদে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে সন্ধ্যার দিকে মিরপুরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিহত মাহবুব রাব্বী তনয়ের বোন জাকিয়া রাব্বী তন্দ্রা বলেন, রোববার ছিল তনয়ের ২৫তম জন্মদিন। তার ভাইয়ের সোমবার বিকালে লোকনাট্য দলের একটি নাটকের মহড়ায় অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন তিনি ওই বাসায় গিয়েছিলেন, তা তারা জানেন না। বোন জাকিয়া আরো জানান, তনয় বেসরকারি আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াশোনা করতেন। নাটকের কারণে পড়াশোনায় বিরতি ছিল। সোমবার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে তনয়ের নাটকের মহড়ায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। তনয় লোকনাট্য দলের হয়ে ‘কঞ্জুস’ নাটকের ২০০টি পর্বে অংশ নিয়েছেন। তার চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক লাইব্রেরিয়ান খন্দকার ফজলুর রহমান জানান, সকালে ভার্সিটিতে তার পরীক্ষা ছিলো। পরীক্ষার জন্য বাসা থেকে বের হন তনয়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন পরীক্ষা শেষে শিল্পকলায় যাবেন। ফজলুর রহমান বলেন, তনয় নাটক করতো। আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে নাটক করতে গিয়েই জুলহাজের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু ঘটনার দিন জুলহাজের বাসায় যাওয়ার কথা তার মাকে জানাননি তনয়। তনয়কে এর আগে কেউ হুমকি ধমকি দিয়েছে বলে তাদের জানা নেই। তিনি মনে করেন জুলহাজকে হত্যা করার সময় হয়তো তনয় বাধা দিয়েছিলো বা তার বন্ধু হিসেবেই তনয়কে হত্যা করা হয়েছে। তনয়ের কোনো শত্রু ছিলো বলে তাদের জানা নেই। এছাড়া তনয় চাপা স্বভাবের বলে জানান তার চাচা।
স্বজন ও বন্ধুরা জানান, নিহত তনয়ের স্বপ্ন ছিলো একজন ভালো পরিচালক হওয়া। অভিনয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ কুঞ্জুস নাটকে কালা মিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তনয়। তিনি কাজ করতেন লোক নাট্যদলে। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ফ্রান্স, তুর্কি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মঞ্চ নাটকে কাজ করেছেন তনয়। অন্তত ২০টি নাটকে অভিনয় করেছেন। বাবা খন্দকার নূর-ই-রাব্বী চাকরি করেন জাহাজে। মায়ের সঙ্গে রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৭১৩ নম্বর বাড়িতে থাকতেন তনয়। তনয়ের স্বজনরা জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার সারাংপুর সাহেববাড়ি।
গ্রামের বাড়িতে আহত পারভেজ: এদিকে ঘটনার পর ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ওই দিন রাতেই বাড়ি ফিরে গেছেন জুলহাজের বাড়ির প্রহরী পারভেজ মোল্লা। পারভেজের ভাই জাকারিয়া জানান, জুলহাজ দরজা খুলে দেয়ার পর দুর্বৃত্তরা জুলহাজের বাসার ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেন পারভেজ। এসময় তার বাম চোখের উপরে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা। দৌড়ে নিচে নেমে যান পারভেজ মোল্লা। সঙ্গে সঙ্গে দুর্বৃত্তদের একজন তার সঙ্গে নেমে লিফটের পাশে তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে রাখে। চিৎকার করলে মেরে ফেলবো বলে হুমকি দেয় ওই দুর্বৃত্ত। পারভেজ মোল্লার গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরখাদা থানার উষলা গ্রামে।
হত্যাকাণ্ডে জাতিসংঘের নিন্দা
দেশে একের পর এক মুক্তচিন্তার অধিকারকর্মীর নৃশংস হত্যায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে জাতিসংঘ। সামপ্রতিক ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিন্স গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। সামপ্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমেরিকান মিশনের কর্মকর্তাসহ ভিন্ন মতের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন। বিবৃতিতে রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেন, অধিকারকর্মীদের ওপর এ ধরনের হামলা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ঢাকাস্থ মার্কিন মিশনের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু মাহবুব তনয় একই ধরনের সহিংস উগ্রপন্থিদের সর্বশেষ হামলার শিকার উল্লেখ তিনি বলেন, বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা থেকে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে যাদের মতের অমিল রয়েছে- তারাই এর শিকার হচ্ছে। দুই দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাও এ ধরনের একটি ঘটনা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব মানুষেরই সন্ত্রাস, ভীতি এবং বৈষম্যহীন পরিবেশে বাঁচার অধিকার রয়েছে বলে জাতিসংঘ বিশ্বাস করে। এখানে সামপ্রতিক সময়ে যেসব নৃশংস সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বেরই তার নিন্দা জানানো উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের সহিংসতা আরও বাড়াবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বার্নিকাটের বৈঠক আজ: ঢাকাস্থ মার্কিন মিশনের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডে কূটনৈতিক পল্লীতে তোলপাড় চলছে। ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সে মতে প্রতিক্রিয়াও আসছে। ঘটনার রহস্য অনুসন্ধানে ঢাকাকে সর্বাত্মক সহায়তা করতে এরই মধ্যে ওয়াশিংটনের তরফে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ মানবাধিকার সংবেদনশীল বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার পক্ষ থেকেও অভিন্ন প্রতিক্রিয়া আসছে। তুলনামূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো রাজধানীর এমন এলাকায় সংঘটিত চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনাটি নিয়ে সরকারের ভেতরে বাইরেও সমালোচনার ঝড় বইছে। ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে প্রয়োজনীয় প্রয়াস নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের ওপর কূটনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে দফায় দফায় যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসছেন। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র বৈঠকটি আয়োজনের তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে সকাল ১১টায় বৈঠকটি হওয়ার সময়ক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে।
মর্মাহত জার্মানি, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান: মাহবুব তনয় এবং জুলহাজ মান্নানের বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ করে ঢাকাস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. থমাস প্রিঞ্জ ঘটনার দ্রুত এবং পূর্র্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত। এ দু’জন স্পষ্টবাদী অধিকারকর্মীর ওপর নিন্দনীয় হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এটি শুধু দু’জন সাহসী বক্তির ওপর আঘাত নয়, এটি একই সঙ্গে গোটা দেশের মুক্ত মত প্রকাশের অধিকারের ওপর আঘাত। ঘটনা দ্রুত এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করা প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। রাষ্ট্রদূত বলেন, গত কয়েক মাসে এমন আরও অনেক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এখন সময় এসেছে সমাজের সবার সোচ্চার হওয়ার এবং স্বাধীন মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার। নিহতদের পরিবার এবং তাদের বন্ধুদের প্রতি আমি সমবেদনা জানাচ্ছি।
ইউএসএআইডি’র প্রতিক্রিয়া; বৈচিত্র্যময় ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ বিনির্মাণে নিবেদিত ছিলেন জুলহাজ: ওদিকে অপর এক বিবৃতিতে ইউএসএআইডি’র প্রশাসক গেইল স্মিথ বলেন, আমরা ইউএসএআইডি আজ আমাদের একজনকে হারিয়েছি। আমাদের পুরো টিমের পক্ষ থেকে আমি আমাদের ফরেন সার্ভিস ন্যাশনাল জুলহাজ মান্নান, যিনি নির্মমভাবে খুন হয়েছেন, তার পরিবার, বন্ধুমহল এবং সহকর্মীদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি। এটি একটি নির্দয় এবং অমানবিক সহিংসতা উল্লেখ করে ইউএসএআইডি’র প্রশাসক বলেন, যারা এই কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার রয়েছেন আমরা সেই সব কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একই দাবি করছি। প্রশাসক বলেন, অল্প বয়স থেকেই অন্যদের সাহায্য করার প্রতি তীব্র আগ্রহ ছিল জুলহাজের। ওই আগ্রহ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধুই বেড়েছে। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি যা বিশ্বাস করেন তার জন্য লড়াই করতে সব সময় প্রস্তুত ছিলেন। তিনি অন্যের অধিকারের জন্য সোচ্চার ছিলেন। মানবাধিকারের জন্য একজন নিবেদিতপ্রাণ ও সাহসী প্রচারণাকারী জুলহাজ এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার আস্থা ছিল উল্লেখ করে প্রশাসক বলেন, তিনি সকলের জন্য বিশ্বকে আরও উন্নত স্থান করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। জুলহাজের সহকর্মীরা তাকে বিশেষ স্নেহ-ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন। মার্কিন দূতাবাসে প্রথমে তিনি একজন প্রটোকল স্পেশালিস্ট হিসেবে যোগ দেন। গত সেপ্টেম্বরে ইউএসএইড-এ যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত এ পদে ৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ডেমোক্রেসি অ্যান্ড গভর্নেন্স কার্যালয়ে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। এছাড়াও মার্কিন দূতাবাসের ডাইভার্সিটি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আরও উন্মুক্ত ও আন্তরিক কর্মপরিবেশ তৈরি করতে তিনি অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেছেন। তিনি এমন মানুষ ছিলেন, আমরা তাকে আমাদের দলে পেয়ে অসম্ভব ভাগ্যবান ছিলাম। সেবা, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকারের প্রতি তীব্র আগ্রহের পাশাপাশি শেখার প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। বিবৃতির শেষে গেইল স্মিথ বলেন, ‘এই ট্র্যাজেডি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে কর্মরত ইউএসএইড কর্মীদের গভীর সংকল্প এবং ত্যাগ স্বীকার এবং উন্নত বিশ্বের জন্য লড়াই করে চলা প্রত্যেকের সাহসিকতার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। জুলহাজ তার ভাই, মা এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে বন্ধুদের রেখে গেছেন। এদের প্রত্যেকে তাকে হারিয়ে শোকাহত। বেদনার এই সময়ে তাদের প্রতি আমাদের সমবেদনা ও প্রার্থনা রইলো।
সন্ত্রাসের শিকড় সন্ধানের আহ্বান মার্কিন সিনেটর বেন কার্ডিনের: জুলহাজ মান্নানকে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মার্কিন সিনেটর বেন কার্ডিন। এক বিবৃতিতে তিনি সন্ত্রাসের শিকড় সন্ধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ডেমোক্রেটিক দলীয় সিনেটর বেন কার্ডিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্স-এর শীর্ষ একজন প্রভাবশালী সদস্য। তিনি বলেছেন, ব্যক্তিসত্তার জন্য, কর্মের জন্য, কাউকে ভালোবাসার জন্য কিংবা পছন্দের সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করার জন্য যদি কারও বিরুদ্ধে অপরাধ করা হয় তার স্থান আধুনিক সমাজে নেই। এ বিষয়ে অবশ্যই সুস্পষ্ট বার্তা দিতে হবে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকাণ্ডে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে আমি বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানাই। যে কোনো ধরনেরই হোক সহিংস উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে কাজ করার আহ্বান জানাই। তিনি বলেন, মাত্র দু’দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরকে হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে। এর দায় স্বীকার করেছে আইসিস। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্লগার, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী ও অন্যদের ওপর যে সন্ত্রাস হয়েছে তা বিয়োগান্তুক (ট্রাজিক)। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যত কড়াভাবে নিন্দা জানানো সম্ভব সেভাবেই আমি নিন্দা জানাই। এলজিবিটি বিষয়ক ব্যতিক্রমী কর্মী ছিলেন জুলহাজ মান্নান। তিনি ইউএসএইডের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ও স্বার্থের পক্ষে সেবা দিয়েছেন। আমি নিহতদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি। এসব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য দায়বদ্ধ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিকদের নিন্দা: জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার এক টুইটে বলেন, জুলহাজ মান্নান ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র এলজিবিটি ম্যাগাজিনের সমপাদক। তিনি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের অংশও ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য খুনিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ও জ্যেষ্ঠ পরিচালক নেড প্রাইস বলেন, ‘জুলহাস মান্নানের হত্যাকাণ্ডে তীব্র নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মান্নান ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে নিজস্ব স্বতন্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন। বিচার, সমতা ও সবার জন্য মানবাধিকারের কণ্ঠস্বর হিসেবে বাংলাদেশিদের পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। মর্যাদা, সাহসিকতা ও নিঃস্বার্থপরায়ণতার নজির গড়েছেন তিনি। যেসবের পক্ষে তিনি লড়াই করেছেন, তার ভেতরেই বেঁচে থাকবেন তিনি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানাই যাতে এ অর্থহীন অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই বিসওয়াল টুইট করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস পরিবারের প্রিয় সদস্য, আমাদের সহকর্মী জুলহাজ মান্নানকে নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমি ক্ষুব্ধ।
যুক্তরাজ্যের নিন্দা: ওদিকে, এক টুইটে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হুগো সোয়্যার। এক টুইটে তিনি বলেন, অধ্যাপক করিম, তনয় ফাহিম ও জুলহাজ মান্নানের অর্থহীন হত্যাকাণ্ডে আমি ভীষণ মনোক্ষুণ্ন। হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে সাবেক বৃটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট গিবসন এক টুইটে বলেন, আমার বন্ধু ও মানবাধিকার কর্মী জুলহাজকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই। দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।- মানবজমিন
২৭ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ