বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:১০:১০

কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা

কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা

নিউজ ডেস্ক: কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপিতে চলছে অস্থিরতা। অসন্তোষ বিরাজ করছে নেতাকর্মীদের মাঝে। স্থায়ী কমিটিসহ দলের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোর নাম ঘোষণা না হওয়ায় ক্ষোভও বাড়ছে। আর এ ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বিএনপি চেয়ারপারসন ও কেন্দ্রীয় কার্যালয় কেন্দ্রিক কয়েকটি গ্রুপে তৈরি হয়েছে বিরোধ। এরই সূত্র ধরে ক’জন নেতার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে দলীয় মহলসহ গণমাধ্যমে। নেতাকর্মীদের আশঙ্কা- এ অস্থিরতা ঝড়ের রূপ নিয়ে যে কোনো সময় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিতে পারে। ওদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে কমিটি গঠনে ভুল ও পক্ষপাত দুষ্ট তথ্য দিয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিভ্রান্ত করছেন কয়েকজন নেতা। এ ব্যাপারে নেতাকর্মীদের মুখে মুখে ফিরছে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ ও চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নাম। সূত্র জানায়, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী দিনে খালেদা জিয়ার বাসায় থাকেন এবং রাতে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে বসেন। দলের কমিটি গঠনে তার মাধ্যমেই সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের কাছে যায় খালেদা জিয়ার নির্দেশনা। এর মধ্যেই কিছু সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটে যায়। কমিটি ঘোষণায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অনুপস্থিতি নিয়েও কথা উঠেছে। কাউন্সিলের পর প্রথম ধাপে তিনটি পদের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রথম ধাপে মির্জা আলমগীরকে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হলেও তিন ধাপেই কমিটি ঘোষণা করছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। এ নিয়ে মহাসচিবের পদ মর্যাদা বা তার ক্ষমতা নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দলের কমিটি গঠন বা ঘোষণার ব্যাপারে সিনিয়র নেতারাও থাকছেন অন্ধকারে। গুঞ্জন রয়েছে এ ব্যাপারে খোদ খালেদা জিয়াই সিনিয়র নেতাদের কোনো পরামর্শ নিচ্ছেন না। অনেকে এতে অসম্মানিতবোধ করলেও প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। সূত্র জানায়, এ ব্যাপারে মির্জা আলমগীরের কাছে কয়েকজন তাদের ক্ষোভের কথা জানালেও তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ঘোষিত কমিটির ব্যাপারে গত ২৩শে এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গুলশান কার্যালয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি কুমিল্লা বিভাগের একজন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম উল্লেখ করে এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে যার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্য করে দামি গাড়ি কেনা ও গত উপজেলা নির্বাচনে নিজ উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগে বিলকিস শিরিন ও ফরিদপুর বিভাগে শামা ওবায়েদকে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়ায় কয়েকদিন আগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মহিলা দলের দুই নেত্রী শিরিন সুলতানা ও রেহেনা আক্তার রানু। মহিলা দলের পক্ষ থেকে কিছু দাবি-দাওয়াও চেয়ারপারসনের কাছে তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, মহিলা দলের কয়েকজন সিনিয়র নেত্রী রয়েছেন এখন তারা কোথায় যাবেন? এতে ওই দুই মহিলা নেত্রীর ওপর বিরক্ত হয়েছেন খালেদা জিয়া। নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কাউন্সিলের পর তিন ধাপে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৪২টি গুরুত্বপূর্ণ পদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই তরুণ এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত। এ বিষয়টি সিনিয়র ও মাঝারি সারির অনেক নেতাই মেনে নিতে পারছেন না। বিএনপির একজন দায়িত্বশীল মহিলা নেত্রী জানান, মহিলা দলের তরফে চেয়ারপারসনের কাছে কিছু দাবি-দাওয়া জানানোর বিষয়কে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।  
অন্যদিকে পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে উঠেছে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ। দলের একজন সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর ব্যাংক স্টেটমেন্ট এখন নেতাকর্মীদের হাতে হাতে। অন্যদিকে কিছুদিন আগে নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য বেলাল আহমেদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে বিএনপিতে। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়া ও কমিটিতে সুযোগ করে দেয়ার আশ্বাসের মাধ্যমে দলের কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কিছু নেতা সামপ্রতিক সময়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তাদের ব্যাংক হিসাব। তারা গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নিয়েছেন জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন। বিপুল ব্যয়ে নির্মাণ করছেন বাড়িঘর। নেতাকর্মীরা বলছেন, যে নেতার ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রকাশিত হয়েছে তিনি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন এমন তথ্য তারা জানতেন না। ওই নেতার সঙ্গে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের নামও ঘুরপাক খাচ্ছে এ গুঞ্জনে।
এদিকে বিগত কয়েকবছর ধরে সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভাল করতেন সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান। পৌর নির্বাচনের সময় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে থাকায় মোহাম্মদ শাহজাহানকে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যয়নের দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির এক সদস্যসহ কয়েকজনের ব্যাপারে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। ওদিকে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে মনোনয়নপত্র প্রত্যয়নের দায়িত্ব পালন করছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনিটরিং ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান। জানা যায়, পরবর্তীতে অনুষ্ঠেয় ৯টি পৌর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়নের প্রত্যয়নপত্র প্রদানের ক্ষমতা কাকে দেয়া হবে, তা জানতে চেয়ে গত ২০ এপ্রিল দলটিকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। ওই চিঠির জবাবে বিএনপি ইসিকে জানায়, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৌর নির্বাচনে দল মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রত্যয়ন দেবেন। কিন্তু এ চিঠিকে কেন্দ্র করে বিএনপি মহলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে মোহাম্মদ শাহজাহানকে মনোনয়ন প্রত্যয়নের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দলের কতিপয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচারিত অভিযোগের পালে নতুন হাওয়া দেয় এ ঘটনা। এতে দলের একাংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে দলের তরফে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে জানানো হয়, মোহাম্মদ শাহজাহান ইউপি ও পৌর নির্বাচন মনিটরিং ও পরিচালনায় দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। আর আগের মতোই অনুষ্ঠিতব্য ৯টি পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যয়ন করবেন বিএনপি মহাসচিব। দলীয় সূত্র জানায়, ঘোষিত কমিটি নিয়ে অসন্তোষ, পদ বাণিজ্য ও মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে প্রচার হওয়া অভিযোগ ও নেতাকর্মীসহ গণমাধ্যমের কাছে এক নেতার ব্যাংক স্টেটম্যান্ট ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে গত সোমবার দলের মহাসচিবসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। সূত্র জানায়, বৈঠকে খালেদা জিয়ার কাছে অভিযুক্ত নেতাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদ শাহজাহানসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনিটরিং ও পরিচালনার দায়িত্ব নিয়োজিত দুই নেতা সরে দাঁড়ানোর আগ্রহ ব্যক্ত করেন। তারা চেয়ারপারসনকে বলেন, প্রয়োজনে এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করা হোক এবং তারা বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, দলের মধ্যে কে কি রকম, কে কি করতে পারে সবই আমি জানি। যারা এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা বিএনপির মঙ্গল কামনা করে না। তারা দলের স্বার্থে এসব করলে প্রথমেই আমার বা মহাসচিবের কাছে কাগজপত্রগুলো পৌঁছাতেন। কি নিয়ে তদন্ত করতে হবে, কখন কার কি করতে হবে সেটা আমি বুঝবো। এ সময় তিনি তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। এদিকে আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে ফলোআপ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন মির্জা আলমগীর। তার অনুপস্থিতিতে সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহানকে ৫ম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে মির্জা আলমগীর দেশে ফেরার পর যথারীতি তিনিই ষষ্ঠ ধাপের মনোনয়ন প্রত্যয়ন করবেন।
ওদিকে কমিটি গঠন ও মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন তৈরির কারণে অভিযুক্তদের কেউ কেউ তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শোডাউন দিচ্ছেন দলের নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ও গুলশান চেয়ারপারসন কার্যালয়ে। সবমিলিয়ে বিএনপিতে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা।-মানবজমিন

২৮ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে