বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬, ০৩:০৩:০১

টার্গেট কিলিংয়ে আতংক, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা!

টার্গেট কিলিংয়ে আতংক, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা!

মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু: বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশেই বাড়ছে নৃশংস খুনের ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে হত্যার পর দুর্বৃত্তরা পুলিশের সামনে দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় হামলার শিকার হচ্ছেন সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরাও। হতাহত হচ্ছেন তারাও। দু-একটি ঘটনায় কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও অধরাই থেকে যাচ্ছে প্রকৃত খুনিরা। এ ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের দাবি, এসব ঘটনার অধিকাংশই ছিল ‘টার্গেট কিলিং’ বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যার কারণে ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। শুধু তাই নয়, মানুষের ঘরে গিয়ে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
আইনশৃংখলা বাহিনীর এসব যুক্তিকে অজুহাত হিসেবে দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। বরং তারা আইনশৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা ও যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি পুলিশের উল্লিখিত মন্তব্যে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নিজ বাসায়ও এখন অনেকে নিরাপদ মনে করছেন না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের। এ দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। পুলিশে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ, নিয়মিত প্রশিক্ষণ না দেয়া এবং বিভিন্ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন তারা। নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্বলতা ঢাকতে কোনো ঘটনা ঘটলেই পুলিশ এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে সেটিকে ‘টার্গেট কিলিং বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের টার্গেট কিলিং একেবারে নিমূল করা সম্ভব নয়।
কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মঙ্গলবার পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশের পক্ষে ঘরে ঘরে গিয়ে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়।’ এ ক্ষেত্রে তিনি সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ নাগরিকদের নিজস্ব নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি এমএ কাইয়ুম বলেন, আইজিপির ওই বক্তব্য সাধারণ মানুষকে আরও আতংকিত করেছে। দেশবাসী শংকিত হয়েছেন। পুলিশে এখন দলবাজি চলছে, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে এ পুলিশকে দিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ঘটনার পরপরই পুলিশ বুঝে যায়, সেটি টার্গেট কিলিং- এটি আশার কথা। তবে ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে ঘাতকরা চলে যায়, এটি হতাশার কথা। আজকাল অনেকেই ঘটনা ঘটার পর তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে গিয়ে সুবিবেচনাসম্পন্ন কথা বলতে পারছেন না বলে মনে হয়। তাদের কথা শুনে জনমনে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে।’
গত মঙ্গলবার রাজধানীর কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশের সামনে দিয়েই পালিয়ে যায় ঘাতকরা। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে ৭ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও তাদের কাউকে আটক করতে পারেনি। এমনকি সশস্ত্র অবস্থায় চার পুলিশ হামলাকারীদের সামনে পেয়েও তাদের আটকাতে পারেনি। উল্টো পুলিশকে কুপিয়ে ও গুলি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে দুর্বৃত্তরা। এ অবস্থায় পুলিশের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার দাবি, পুলিশ অনেক দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। খবর পাওয়ার ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। খুনিদের জাপটে ধরার পর পুলিশকে কুপিয়েই পালিয়েছে খুনিরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ মনে করেন হামলার খবর পাওয়ার পরও পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কলাবাগান ডলফিন গলির বাসিন্দা একটি সরকারি অফিসের কর্মকর্তা তাহসিনুল হক বলেন, তিনি নিজেই ফোন করে জুলহাজের বাসায় ডাকাতি হচ্ছে ভেবে বিষয়টি থানায় জানান। ওই সময় থানা থেকে বলা হয়, ‘আমরা ফোর্স পাঠাচ্ছি।’ কিছুক্ষণ পর দুটি টহল দল ঘটনাস্থলে স্কয়ার হাসপাতালের উল্টোপাশের গলি দিয়ে অপরটি ডলফিন গলি হয়ে লেক সার্কাসের দিকে আসে। ততক্ষণে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে খুনিরা তখন ডলফিন গলি হয়ে পালাচ্ছিল। পুলিশের টহল ভ্যানটি লেকসার্কাস রোডে জনৈক রাশেদ মোশাররফের বাড়ির সামনে পৌঁছার পর ৫-৬ জন যুবককে দৌড়ে আসতে দেখে।
টহল দলের নেতৃত্বে থাকা এসআই শামীম আহমেদ বলেন, তিনি (শামীম), এএসআই মমতাজ, কনস্টেবল আজগর ও নূরুল ইসলাম  ছিলেন গাড়িতে। চালক ছিলেন কনস্টেবল মজিবর। দৌড়ে আসা যুবকদের সন্দেহ হলেই তিনি তাদের ধরতে বলেন। গাড়ির পেছনে থাকা এএসআই মমতাজ তাদের একজনকে জাপটে ধরলে তাদের আরেক সহযোগী পিঠে ও কপালে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ওই সহযোগীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তবে ওই যুবকের ব্যাগটি থেকে যায় পুলিশের হাতে।
এসআই শামীম আরও জানান, তিনি নিজেই তার পিস্তল দিয়ে যুবকদের পা লক্ষ্য করে গুলি করেন। কনস্টেবল নূরুল ইসমলামও শটগান থেকে এক রাউন্ড গুলি করে। এ সময় হামলাকারীরা শামীমকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিয়ে একটি গর্তে পড়ে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এসএসআই মমতাজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর কনস্টেবল মজিবর ও নূরুল তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে মিরপুর রোডের দিকে চলে যায়।
এর আগে গত বছরের ২৩ অক্টোবর মিরপুরে পুলিশের চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে এসআই ইব্রাহিমকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্র্বৃত্তরা। এর কয়েকদিন পর আশুলিয়ায় চেকপোস্টেও দিনদুপুরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় খুন হন কনস্টেবল মুকুল হোসেন। একের পর এক ঘটনায় সশস্ত্র অবস্থায় থাকার পরও ঘাতকদের হাতেনাতে ধরতে না পারায় পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে এগুলো ‘টার্গেট কিলিং বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ এ অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ঘটনা প্রতিরোধ করা খুব সহজ নয়। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, কেউ যদি হত্যার জন্য কাউকে টার্গেট করে, সেক্ষেত্রে আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষে তা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকানোর মতো প্রচুর জনবলও বাংলাদেশ পুলিশে নেই।  
তবে কোনো ঘটনা ঘটলে, সে ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করলে তদন্তে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম। তার মতে, ‘যে ঘটনাটি ঘটল সেটি যদি টার্গেট কিলিং না হয় সেক্ষেত্রে তদন্তের আগে এ ধরনের মন্তব্যে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে যাবে।
আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে পুলিশের সাবেক আইজি এমএ কাইয়ুম বলেছেন, কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধান, বিচার, বিশ্লেষণ না করে মন্তব্য করলে তদন্তে তার প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটি ঘটনা ঘটার পরপরই যদি সেটাকে টার্গেট কিলিং কিংবা জঙ্গি হামলা বলা হয় তখনই এর তদন্তের ওপর প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটি কোন ধরনের ঘটনা তা সরকার বা পদস্থ কর্মকর্তাদের মুখ থেকে উল্লেখ না করাই ভালো। এতে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে এবং প্রকৃত অপরাধীরাও পার পেয়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
সন্ত্রাসীদের হামলার যেসব ঘটনাকে টার্গেট কিলিং বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যাকাণ্ড। এর মাত্র ৫ দিন পর রংপুরে খুন হন জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি। একই বছরের ২৩ অক্টোবর আশুরার আগের রাতে হোসেনি দালানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ১ নভেম্বর রাজধানীর শাহবাগে জনাকীর্ণ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন। একই দিনে প্রায় একই সময়ে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় নিজ অফিসে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদ রশিদ টুটুলসহ তিনজন।
এর আগে ওই বছরের ৫ অক্টোবর বাড্ডায় নিজ বাসায় খুন হন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খিজির খান। ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট রাজাবাজারে নিজ বাসায় একই কায়দায় খুন হন হাইকোর্ট মাজারের খতিব ও একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপক নূরুল ইসলাম ফারুকী। গত বছরের ২৬ ফেব্র“য়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় স্ত্রীর সামনেই খুন হন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। একই বছরের ১২ মে সিলেটে প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। এর কয়েকদিন পর ৬ আগস্ট ঢাকার গোড়ানে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়। এসব খুনের ঘটনাকে পরিকল্পিত এবং টার্গেট কিলিং বলে দাবি করা হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের পক্ষ থেকে। চাঞ্চল্যকর এসব খুনের ঘটনার বেশির ভাগই এখনও রয়ে গেছে রহস্যাবৃত্ত।-যুগান্তর

২৮ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে