শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬, ০৬:১৪:৫৭

র‌্যাব ও পুলিশ কী প্রস্তুত

র‌্যাব ও পুলিশ কী প্রস্তুত

নেসারুল হক খোকন : প্রশিক্ষিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি ও নতুন নতুন কলাকৌশল নিয়ে থেমে থেমে কিলিং মিশন বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। কিন্তু এর বিপরীতে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা কি সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত- এ প্রশ্নই এখন ঘুরেফিরে আসছে। কেননা একের পর এক টার্গেট কিলিং বাস্তবায়ন করে প্রকৃত খুনিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন মন্তব্য করে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন বলেন, এসব টার্গেট কিলিং থামানো না গেলে একপর্যায়ে ‘মাসকিলিং’ বা গণহত্যায় অংশ নেবে এ খুনিরা। তখন পরিস্থিতি পুরোপুরি আইনশৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। তাই এমন অবস্থা আসার আগেই শক্ত হাতে জঙ্গি, সন্ত্রাস দমনসহ এ ধরনের টার্গেট কিলিং বন্ধে এখনই আইনশৃংখলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে- যারা টার্গেট কিলিং করছে তারা কিন্তু একটা মতাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য করছে। এক্ষেত্রে তারা জীবন দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো সদস্য কি সহজে মৃত্যুঝুঁকি নিতে চাইবেন? চাইবেন না। কারণ একজন পুলিশ সদস্য মোটা অংকের অর্থ দিয়ে নিয়োগ পান। তার সঙ্গে পরিবারের নিরাপত্তা জড়িত। তাই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে উচ্চ মনোবল তৈরি করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশকে জনগণের আরও কাছে যেতে হবে। আর একেকজনের একেক কথা বলা বন্ধ না করলে তদন্ত কখনোই সঠিক গতিতে এগোবে না। প্রকৃত ঘটনা বের করে আনতে হবে। তবেই এসব অপরাধ কমবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারির কারণে শত শত অঘটন রোধ করা যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো মিডিয়ায় সেভাবে আলোচিত হয় না। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি ঘটনা ঘটলে মিডিয়ায় সেটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্লগার হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই।
এদিকে সূত্র জানায়, একের পর এক টার্গেট কিলিং বাস্তবায়নের মূল পরিকল্পনাকারীরা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে মাঠপর্যায়ে দু-একজন ভাড়াটে কিলার বা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ধরা পড়লেও টার্গেট কিলিং বন্ধ হচ্ছে না। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বা মূল পরিকল্পনাকারীর সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কিলিং মিশন বাস্তবায়নকারীদের যোগাযোগ থাকে না। কারণ কিলিং মিশনের নির্দেশনা আসে কয়েকটি ধাপ ও কয়েক স্তরে। এর ফলে ভাড়াটে কিলার গ্রেফতার হলেও তার কাছ থেকে উপরের ধাপে থাকা পরিকল্পনাকারীর তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে এমনও মনে হতে পারে, এর পেছনে বহু দূর থেকে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে। একটু স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, যারা বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে চায়, এখানে আইএস আছে এমন তকমা দিয়ে ভবিষ্যতে সন্ত্রাস দমনের নামে ঢুকে পড়ার কু-মতলব রয়েছে তারাই এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে উগ্র-জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ঘাঁটি থাকার প্রচারণা উদ্দেশ্যমূলক। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন বাংলাদেশে যারা আইএসের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে কিনা সেটি এখনই ভেবে দেখার সময় এসেছে। আইএস প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে আইএস বা অন্য কোনো উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রতিরোধ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। আর যদি এই শত্রু দেশের বাইরের কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে থাকে তাহলে তা সরকারকেই মোকাবেলা করতে হবে। আবার কেউ কেউ এমনও আশংকা করেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আকার-ইঙ্গিতে যাদের আমরা সন্দেহ করছি সেই রাষ্ট্রের যদি সত্যিই ইন্ধন থাকে তাহলে এখনই দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে সরকারের একার পক্ষে সফল হওয়া কঠিন হবে। কেননা সবার আগে দেশের স্বার্থ বড় করে দেখতে হবে। ইতিমধ্যে তারা মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে হানা দিয়েছে সেসব দেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আইএসের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে আইএস বলে আসলে কিছু নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব খুনি-সন্ত্রাসীকে নির্মূল করতে পুলিশ বাহিনীই পুরোপুরি সক্ষম। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। হত্যাকারীরা অচিরেই ধরা পড়বে।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের কথায় জনমনে স্বস্তি আসছে না। কারণ বিভিন্ন সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারকৃত কিলারদের জবানবন্দিতেই বেরিয়ে এসেছে তাদের ভয়ংকর রণকৌশলের বর্ণনা। জানা গেছে, কিলিং মিশন বাস্তবায়নে তাদের দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনার কথাও। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ কলাবাগানের জোড়া খুন। সব কটি খুনের ঘটনাই নিশ্চিতভাবে টার্গেট কিলিং। প্রতিটি ক্ষেত্রেই খুনিরা সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট নির্ধারণ করে সময় নিয়ে এগিয়েছে। বিশেষ করে ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের জোড়া খুনের আগে ওই এলাকায় ২ মাস ধরে খুনিরা ভাড়া বাসায় অবস্থান করে। খুনিরা জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়ের ওপর অনেকটা আইনশৃংখলা বাহিনীর মতোই নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে- এমন তথ্যও বেরিয়ে এসেছে। এরপর নিরাপদে পালিয়ে যেতে তারা পোশাকও পরিবর্তন করে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় নিখুঁতভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের চিনতেও পারছে না। গ্রেফতারের বিষয় তো অনেক পরে। ফলে একের পর এক এ ধরনের টার্গেট কিলিং জনমনে আতংক সৃষ্টি করছে।
তবে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরপরই সরকারের তরফে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকেই বলছেন, এ ধরনের টার্গেট কিলিং যদি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে হয়েও থাকে তাহলে কি টার্গেটের সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়বে? এখন ব্লগার বা অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা খুনিদের টার্গেট হলেও ভবিষ্যতে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যে উগ্রবাদীদের টার্গেটে পরিণত হবেন না তার গ্যরান্টি কোথায়?
একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের কারণ জানতে চাইলে পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনীর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের কারণ হচ্ছে অন্যের মতামত গ্রহণে চরম অসহিষ্ণুতা। ব্লগাররা তাদের লেখালেখির মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে আক্রমণ করছে। তখন উগ্রবাদী গোষ্ঠী ব্লগারদের টার্গেট কিলিংয়ের শিকারে পরিণত করছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি কি লেখালেখি করল, না করল সেটা অগ্রাহ্য না করে অন্যপক্ষ তার ওপর চড়াও হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে পরমত অসহিষ্ণুতাও চরমভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে আইনশৃংখলা বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, দেশের জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা নিতান্তই কম। ফলে ১৬ কোটি মানুষের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে পুলিশি নজরদারির মধ্যে আনা একটা দুরূহ ব্যাপার। যারা একবার অপরাধে জড়িয়েছে তাদের হয়তো নজরদারির আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু তাদের মতামতের দ্বারা আরও কতজন প্রভাবিত হয়ে অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটি অনুমান করা কখনোই সম্ভব নয়। অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধী গ্রেফতার না হওয়া প্রসঙ্গে অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে অপরাধীরা অনেক ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তাছাড়া আইনশৃংখলা বাহিনীর কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধী গ্রেফতারের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দিচ্ছেন। এতে অপরাধীরা সহজেই নিজেকে আড়াল করতে পারছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আগে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে সহজেই অপরাধীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন একজন ছিঁচকে চোরও অপরাধ ঘটিয়ে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে রাখছে অথবা সংযোগ পরিবর্তন করছে। এতে করে তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কে কখন কোন মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যাচ্ছে তা মনিটর করাও দুরূহ কাজ।
টার্গেট কিলিং বন্ধে আইনশৃংখলা বাহিনীর সক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, টার্গেট কিলিং বন্ধ করা অত্যন্ত কঠিন কাজগুলোর একটি। যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে তারা বয়সে তরুণ। মিশন বাস্তবায়নে তারা রীতিমতো হোমওয়ার্ক করছে। কখন হামলাটি হবে- সেটি যেমন আগে থেকে জানা যাচ্ছে না, তেমনি কার ওপর হবে সেটিও জানা কঠিন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে থাকে তখন এ ধরনের ঘটনা বাড়ে। ব্লগার হত্যার পর দৃষ্টান্তমূলক বিচারের অভাবেই এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডগুলো এক ধরনের সামাজিক রোগ। এটিকে প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের গোড়ায় যেতে হবে। পরিবার এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকেই তরুণদের মানসিকতার পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে।
পুলিশের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশে কিছুটা আধুনিকায়নের কাজ হচ্ছে, কিছু নতুন প্রযুক্তিও আসছে। কিন্তু ব্রিটিশ আইন দ্বারা গঠিত পুলিশ এ ধরনের অপরাধ দমনে কতটা সক্ষম সেটি নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার কারণেও তাদের কাজের দক্ষতা কমছে। পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হলে তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়েও মানুষকে আরও সতর্ক হতে হবে। সামাজিকভাবে অপরাধীদের প্রতিরোধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।-যুগান্তর

২৯ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে