শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:৩০:০৪

ফিলিপাইনি পরামর্শকের মৃতদেহ মিলেছিল ম্যানিলার রাস্তায়

ফিলিপাইনি পরামর্শকের মৃতদেহ মিলেছিল ম্যানিলার রাস্তায়

হামিদ বিশ্বাস : রাজকোষ কেলেঙ্কারির ঘটনার ঠিক আগের ঘটনা এটি। গত বছরের ২৭শে ডিসেম্বর ম্যানিলার একটি রাস্তার পাশে পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিলিপিনো পরামর্শক এডিসন পৃষ্‌যভেল্লানোসের মৃতদেহ। তিনি একটি প্রকল্পের অধীনে কাজ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। তার মৃত্যুর সংবাদটি ফিলিপাইন থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি অবহিত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের। তবে ওই খবরটিকে অতি পোপনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল বার্তায়।

গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। যদিও তা প্রকাশ পায় একমাস পরে। এ চুরির ঘটনায় এখন পর্যন্ত বিদেশি যেসব ব্যক্তির জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ফিলিপিনো। চুরির অর্থ সরাতে দেশটির রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনকে ব্যবহার করা হয়েছে। আর যে অ্যাকাউন্টে অর্থ সরানো হয়েছে ওই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল গত বছরের মে মাসে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিসনের মৃত্যুটি ছিল রহস্যজনক। অর্থ লোপাটের ঠিক আগে এডিসনের এই রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত সংশ্লিষ্টদের গোচরে আসেনি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকে ডাটা ওয়্যারহাউজ স্থাপন প্রকল্পে কাজ করে ইন্দ্রা ফিলিপাইন। এ প্রক্রিয়া তৃতীয় একটি পক্ষের কর্মী থাকার কথা থাকলেও পুরো কাজ ইন্দ্রা ফিলিপাইনের কর্মীরাই সম্পন্ন করে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ইআরপি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের এপ্রিলে স্পেনের ইন্দ্রা সিস্টেমাসের সঙ্গে চুক্তি হয়। একই প্রকল্পের আওতায় ডাটা ওয়্যারহাউজ স্থাপনের জন্য চুক্তি হয় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে।

 ইন্দ্রা সিস্টেমাসের সঙ্গে চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়ন করে ফিলিপাইনে এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্দ্রা ফিলিপাইন। ইআরপি ও ডাটা ওয়্যারহাউজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ থেকে মানবসম্পদ সংগ্রহে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ইন্দ্রা ফিলিপাইন। তবে অ্যাগ্রিয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ওই কর্মীদের পরে নিজস্ব কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয় ইন্দ্রা ফিলিপাইন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নকালে ফিলিপাইনের তিন নাগরিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাজ করেছেন। এর মধ্যে প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন এডিসন যভেল্লানোস।

পরে আন্তঃব্যাংক দ্রুত লেনদেনের জন্য আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) ব্যবস্থা স্থাপনেও কাজ করেন ফিলিপাইনের বেশ কয়েকজন নাগরিক। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় চলমান তদন্তেও সুইফট সিস্টেমের সঙ্গে আরটিজিএস ব্যবস্থার সংযোগের বিষয়টি ওঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় এডিসন  যভেল্লানোসের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইন্দ্রা ফিলিপাইন। গত ৬ই জানুয়ারি ফিলিপাইনের ইন্দ্রা কোম্পানি থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়, ‘শুরু করছি একটি বেদনাদায়ক নোট দিয়ে, এটা নিশ্চয় বড় ধরনের দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক খবর যে সহকর্মী এডিসন যভেল্লানোস ২০১৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ই-বার্তায় আরও দাবি করা হয়, এডিসন বাইসাইকেলে করে আমাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন ব্যায়াম করছিলেন তখন হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। তার স্থানে স্থলাভিষিক্ত করা হয় মি. স্টেসি লাও কে। যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরবর্তী কর্মকাণ্ডে যোগাযোগের একমাত্র ব্যক্তি।

ইন্দ্রার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের সিনিয়র কনসালট্যান্ট রিজ্জিয়া জন মেরি সি. জামোরা প্রেরিত ই-বার্তাটি অনেক বেশি গোপনীয় বলে উল্লেখ করা হয়। ওই ই-মেইল বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়জন কর্মকর্তার কাছে। তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি উপমহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। এরা সবাই সেন্ট্রাল ব্যাংক স্ট্রেংদেনিং প্রজেক্ট সেল (সিবিএসপিসি), আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট ও একাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, একজন ফিলিপাইন নাগরিকের মৃত্যুর খবর শুনেছি। তার লাশ দেশটির একটি সড়কের পাশে পড়ে থাকে। কম বয়সী ওই নাগরিকের মৃত্যুটা রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি। এডিসন নামের ওই কর্মকর্তা একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন।

একজন জিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তা জানান, এডিসনের মৃত্যু ও বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা এখনও অস্পষ্ট। তিনি বলেন, রিজার্ভ লোপাটের ঘটনা চলতি বছরের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঘটলেও পরিকল্পনা করা হয় এক বছর আগে। কারণ ফিলিপাইনে যেসব ব্যাংকে টাকা নেয়া হয় ওই সব ব্যাংকে ২০১৫ সালে মে মাসে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কিছু বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করেন। বিশেষত যেসব দেশ সফটওয়্যার দিয়েছে সেসব দেশের লোক বেশি কাজ করেন। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দেশের নাম উল্লেখ করতে রাজি হননি তিনি।

গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের গচ্ছিত অর্থের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার দুটি ব্যাংকে পাঠানো হয়। সন্দেহ হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া দুই কোটি ডলার সঙ্গে সঙ্গে আটকে যায়। অন্যদিকে ফিলিপাইনে যাওয়া আট কোটি ১০ লাখ ডলার ক্যাসিনো হয়ে অন্য দেশে পাচার হয়ে যায়। তবে ক্যাসিনোর অপারেটর কিম অং ফিলিপিন্সের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত দিয়েছেন। অর্থ চুরির ঘটনায় করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

এছাড়া এ ঘটনায় তাদের করা মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। তদন্তের অংশ হিসেবে তারা ফিলিপাইন ও ঘুরে এসেছে। সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এ অর্থ চুরিতে এ পর্যন্ত ২০ বিদেশির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ছিল বলেও ধরা পড়েছে তদন্তে। -এমজমিন
২৯ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে