শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ০৫:৪৭:৫৪

জঙ্গি হামলার ২৪ মামলায় রহস্যভেদ করা যায়নি

জঙ্গি হামলার ২৪ মামলায় রহস্যভেদ করা যায়নি

সাহাদাত হোসেন পরশ ও ফসিহ উদ্দীন মাহতাব : রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত তিন বছরে জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২৯টি মামলা হয়েছে। উগ্রপন্থিদের হামলায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হন আরও অন্তত ১০ জন।

এই সময়ে হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে হামলাসহ পৃথক পাঁচটি স্থানে বোমা হামলা চালানো হয়। একের পর এক জঙ্গিদের এসব হামলার ঘটনায় দায়ের করা ২৪টি মামলারই পুরোপুরি রহস্যভেদ করতে পারেনি পুলিশ। মাসের পর মাস ধরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে এসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। বারবার পরিবর্তন হচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তাও। ২৯টি হামলার মধ্যে মাত্র ৪টি ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ।

গত তিন বছরে একমাত্র ব্লগার আহেমদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। উগ্রপন্থিদের হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে পুলিশ। ওই অগ্রগতি প্রতিবেদনের সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর কলাবাগানে নিজ বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে। দীর্ঘদিনেও অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দৃশ্যমান অগ্রগতি ও হামলাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় নিহতের স্বজনরা ক্ষুব্ধ ও আশাহত। পুলিশের সক্ষমতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। সর্বশেষ কলাবাগানে জোড়া খুনের তদন্তে এফবিআই সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে এ ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সব মামলার গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। কয়েকটি ঘটনার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। একটির রায়ও হয়েছে। বাদবাকি মামলার তদন্ত শেষে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব হামলায় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। একটি মহল চাপাতি দিয়ে খুন করে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে। এদের রুখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট তৎপর।

মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, যে কোনো মামলা তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকা থাকলে অপরাধীরা সুযোগ নেয়। আলামতও নষ্ট হয়। বারবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।

নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক  বলেন, অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের উচিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। দেশবাসীও নীরব। যেভাবে ভূমিকা রাখলে কাজ হবে গণমাধ্যমের সেই ভূমিকাও দেখা যাচ্ছে না। উগ্রপন্থিদের পেছনের শক্তিকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরি করতে হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিন বছরে উগ্রপন্থিদের ২৯ হামলার মধ্যে ২০টি হয়েছে ২০১৫ সালে। এর মধ্যে গত বছরের অক্টোবরেই হামলা হয়েছে ৬টি। ওই মাসে খিজির খান, জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও, ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার, এএসআই ইব্রাহিমকে হত্যা, খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে বোমা হামলা করা হয়।

অবশ্য কেবল তাভেলা হত্যায় উগ্রপন্থিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছে পুলিশ। গত তিন বছরে উগ্রপন্থি হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে অধিকাংশ আসামিকে 'সন্দেহভাজন' হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন এক আসামিকে গ্রেফতার করার কথা প্রতিবেদনে বলা হয়। ওই মামলার তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর সহায়তা নেওয়া হয়। আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এফবিআইর পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠানো হয়েছে। আলামত পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া গেলে আসামি শনাক্ত ও মূল রহস্য শনাক্ত হবে বলে মনে করছে তদন্ত সংস্থা। চলতি মাসের ৭ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন হত্যার ঘটনায় একজনকেও গ্রেফতার করা যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে; তিনজন পলাতক। এএসআই ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় পাঁচজন, কনস্টেবল মুকুল হত্যায় পাঁচজন, যাজক লুক সরকার হত্যাচেষ্টায় ছয়জন, পঞ্চগড়ে মঠপ্রধান হত্যায় চারজন, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হোসেন আলী সরকারকে হত্যায় দু'জন, দিনাজপুরে ইসকন মন্দিরে হামলায় দু'জন, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলায় পাঁ?চজন, জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যায় চারজন, ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় হত্যায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত তিন বছরে দেশে যেসব উগ্রপন্থি হামলা হয়েছে তার অধিকাংশের সঙ্গে জড়িত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। হামলার ধরনেও পরিবর্তন এনেছে উগ্রপন্থিরা। বিস্তৃত করেছে তাদের লক্ষ্য। আগে শুধু ব্লগারদের টার্গেট করা হলেও এখন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার ভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিরা হামলার শিকার হচ্ছেন।

একই সঙ্গে শুধু 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়ে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষকদের হত্যা নয়; হামলা চালানো হয়েছে শিয়া মসজিদে। দিনাজপুরে কান্তজিউ রাসমেলায় বোমা হামলা, কাহারোলে ইসকন মন্দিরে হামলা, রংপুরে বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনকে হত্যাচেষ্টা, পাবনায় খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, একাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা, বিদেশি নাগরিক হত্যা, পঞ্চগড়ে মঠপ্রধানকে হত্যা করা হয়।

অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিরপুরে ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার রায়ে দু'জনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসামিদের মধ্যে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে; একজন পলাতক। তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন হত্যাচেষ্টা মামলার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একেএম শফিউল ইসলাম হত্যা মামলা ও হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলে প্রস্তুতি সমাবেশে হামলা মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

অগ্রগতি প্রতিবেদনে অনেক মামলায় আসামি গ্রেফতারের কথা বলা হলেও কেন চার্জশিট দাখিল করা যাচ্ছে না- এমন প্রশ্নে পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, অনেক মামলায় সন্দেহভাজন আসামি গ্রেফতার করা হলেও জড়িতদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ জঙ্গিরা 'কাট-আউট' পদ্ধতিতে কাজ করায় তাদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। অধিকাংশ হামলার পর কথিত আইএস ও আল কায়দার নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ঘটনায় মাঠ পর্যায়ের জড়িতদের চিহ্নিত করা গেলেও তাদের 'গুরুদের' শনাক্ত করা যায়নি।

তবে অনেকের ভিন্নমতও রয়েছে। তারা বলছেন, 'উগ্রপন্থিদের মামলার ব্যাপারে নিরবচ্ছিন্নভাবে তদন্ত করার মতো দক্ষ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তা হাতে গোনা কয়েকজন। তথ্য-প্রযুক্তিভাবে জঙ্গিরা অনেক দক্ষ। তাদের শনাক্ত করতে গেলে যে ধরনের দক্ষতা থাকা দরকার তা অনেক পুলিশ সদস্যের নেই।'

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশাল ইউনিট, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এসব মামলার তদন্ত করছে। এরই মধ্যে কিছু ঘটনায় জড়িতরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছে। তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে হামলা ও পুলিশ হত্যায় জড়িত জেএমবি নেতা হোজ্জা ওরফে আলবানি এরই মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। -সমকাল

৩০ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে