নিউজ ডেস্ক : কেন্দ্রীয় সম্মেলন শেষে কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীকে সংগঠিত করে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা-প্রস্তুতি নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু এর এক মাসের মাথায় দলটি সাংগঠনিকভাবে আরও এলোমেলো অবস্থার মধ্যে পড়েছে। পদ-পদবি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই ও ঘোষিত কমিটি নিয়ে কারও কারও অসন্তোষের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিভাগের কার্যক্রমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত সাংবাদিক শফিক রেহমান। তার সঙ্গে আর কাউকে জড়ানো হয় কি না—এ নিয়ে অনেক নেতা উদ্বেগের মধ্যে আছেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার একাধিক মামলার গতি বৃদ্ধি নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে দলে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে দলটির ভেতরকার এই পরিস্থিতির কথা জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব নেতা বলেন, কমিটিতে নিজেদের থাকা এবং পছন্দের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে দলের উচ্চপর্যায়ের কিছু নেতার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছে। একে অপরকে ঘায়েল করতে নানা কৌশল আঁটছেন। এরই অংশ হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলামের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে গত এক বছরের ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করে দলের ভেতরের একটি অংশ। এটাকে পৌরসভা ও চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ টাকা বলে প্রচার করা হয়। কয়েকটি গণমাধ্যমেও এ খবর বের হয়। এর পেছনে দলের একটি পক্ষের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, তাইফুল ইসলামের সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য, একজন যুগ্ম মহাসচিব ও চেয়ারপারসনের একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সখ্য রয়েছে। এসব নেতার বিরুদ্ধে ‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ অপবাদ ছড়ানোর লক্ষ্যে তাইফুলের ব্যাংক হিসাবের এই লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ, ওই নেতারা দলের প্রার্থী বাছাই-প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন।
দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এ ধরনের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৫ এপ্রিল বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, বিএনপির বিষয়ে জনমনে ও দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের খবর প্রচার করা হয়েছে।
তাইফুল ইসলাম বলেন, স্বার্থান্বেষী একটি পক্ষ তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স টি এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবের এক বছরের লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করে। তারা বোঝাতে চেয়েছে, দলের সহদপ্তর সম্পাদকের পদ পাওয়ার পর এই টাকা ব্যাংক হিসাবে ঢুকেছে। অথচ এর আগের দুই বছরেও প্রায় একই পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করা হয়নি।
নেতাদের একাংশের অভিযোগ, অপবাদ দিয়ে খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন কিছু নেতার অবস্থান নষ্ট করা ও স্থায়ী কমিটিতে কোনো কোনো নেতার অন্তর্ভুক্তি ঠেকানোর লক্ষ্যে এ ধরনের তৎপরতা চলছে। এর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতার ভূমিকা আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, মামলা, হামলা ও নির্যাতনে বিএনপি এমনিতেই কাহিল। এসবের উদ্দেশ্য বিএনপিকে আরও কাহিল করা। নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে দলকে ভেতর থেকে অস্থিরতায় রাখা।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা সেলের সমন্বয়ক মো. শাহজাহান বলেন, ‘দলীয় স্বার্থে দলে কোনো বিরোধ বা ঠেলাঠেলি দেখি না। তবে সরকারের স্বার্থ রক্ষার তৎপরতা আছে। কেউ না বুঝে, আবার কেউ কেউ বুঝেশুনে সরকারের ফাঁদে পা দিচ্ছে। এ থেকেই হয়তো দ্বন্দ্বের উৎপত্তি।’
গত বছরের শুরুতে সরকার পতন আন্দোলনে ব্যর্থতা, টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে পেট্রলবোমা, গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার অসংখ্য মামলা এবং পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে বছর খানেক আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর গত ১৯ মার্চ দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি দলটি আবার রাজনীতির মাঠে ফিরে আসে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন মুখের প্রাধান্যনির্ভর কমিটি দিয়ে ধীরেসুস্থে দলকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করেন শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে শুরুতেই এ পরিকল্পনা হোঁচট খায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, সুন্দর একটা সম্মেলন হলো। কিন্তু নানা কারণে দলে যে গতি আসার কথা ছিল, তা আসেনি।
সম্মেলনের এক মাসের মাথায় তিন দফায় দলের মহাসচিবসহ ছয়টি পদে ৪১ জন নেতার নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। তাদের ৩১ জন নতুন মুখ, যাঁদের পাঁচ-ছয়জনের যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়ে দলের ভেতরে সমালোচনা আছে। অবশ্য বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঘোষিত কমিটির ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সিদ্ধান্ত সঠিক হলেই যথেষ্ট।
দলীয় সূত্র জানায়, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মূল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন খালেদা জিয়া। এ কাজে যখন যাকে দরকার মনে করছেন, তার সহযোগিতা নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ ও বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে নাম ঘোষণা বাকি আছে। এসব পদের বিষয়ে কথা বলতে গত সপ্তাহে লন্ডনে তারেক রহমানের কাছে গেছেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠজন।
দলের এমন এলোমেলো অবস্থার মধ্যে সাংবাদিক শফিক রেহমানের গ্রেপ্তার ও তাকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের’ মামলায় জড়ানোর ঘটনা বিএনপির নীতিনির্ধারকদের শঙ্কায় ফেলেছে। তাদের আশঙ্কা, শফিক রেহমানের ওই মামলায় বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ আরও নেতাকে জড়ানো হতে পারে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার ও খালেদা জিয়ার মামলার গতি বাড়ানোর উদ্দেশ্য বিএনপির স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করা। আর গয়েশ্বরের দাবি, শফিক রেহমানের গ্রেপ্তার সরকারের ‘নার্ভাসনেস’। সরকারকে মনের বাঘে খাচ্ছে। তারা বাঘ খুঁজে পাচ্ছে না, তাই বনে আগুন দিচ্ছে।
বিএনপির এই অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির শুভাকাঙ্ক্ষী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বার্থে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর দরকার। কিন্তু দলটি কেন জানি পারছে না। তিনি বলেন, ‘কিছু লোক আছে খালেদা জিয়াকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। তারাই বলে আপনাকে সব ক্ষমতা দেওয়া হলো, আপনি সব ঠিক করে দিন। এ অবস্থার পরিবর্তন যত দিন না হবে, তত দিন এসব সমস্যা কাটবে না।’-প্রথম আলো
৩০ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন