রবিবার, ০১ মে, ২০১৬, ১২:২০:৩৯

ভার্টিক্যাল ভিলেজ ও বাংলাদেশ

ভার্টিক্যাল ভিলেজ ও বাংলাদেশ

আবু এন. এম. ওয়াহিদ: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, উনিশ শ’ সত্তর দশকের গোড়ার দিকে উপমহাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক নিহার রঞ্জন রায় কোনো এক সেমিনার উপলক্ষে কলকাতা থেকে ঢাকা এসেছিলেন। ওই বার তিনি ঢাকায় বেশ কয়েকটা বক্তৃতা করেন। বাংলা একাডেমীর সামনে, তাঁর
একটা বক্তৃতা অন্য অনেক শ্রোতার সাথে আমারও শোনার সৌভাগ্য হয়েছিলো। বক্তৃতার এক পর্যায়ে ভারতবর্ষের গ্রামগুলো গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমাদের উপমহাদেশে দু’ ধরণের গ্রাম দেখা যায় - লিনিয়ার এবং কংলোমারেট।
লিনিয়ার গ্রাম গড়ে ওঠে নদীর পাড়ে, রাস্তার ধারে, অথবা পাহাড়ের পাদদেশে লম্বাভাবে। বাড়িগুলো একটার পর একটা পাশাপাশি একই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পক্ষান্তরে কংলোমারেট গ্রাম বৃত্তাকারে চারদিকে গড়ে ওঠে কোনো বড় প্রাচীন গাছ, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, অথবা হাট বাজারকে কেন্দ্র করে। দু’ রকমের থাকলেও, উপমহাদেশের অধিকাংশ গ্রামই লিনিয়ার। এখানে কংলোমারেট গ্রাম খুব একটা দেখা যায় না। লিনিয়ার এবং কংলোমারেট ছাড়া, সময়ের প্রয়োজনে এখানকার গ্রামগুলো যে ভার্টিক্যালি উপরের দিকেও উঠতে পারে, এব্যাপারে অধ্যাপক রায় তখন কোনো
ইঙ্গিত দেননি।

আজকের বাংলাদেশে - জমির পরিমাণ, জনসংখ্যার ঘনত্ব, এবং যে হারে প্রতি বছর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে, তাতে মনে হয় সময় এসে গেছে ভার্টিক্যাল ভিলেজের কথা জরুরি ভিত্তিতে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার। ছোট ছোট ৮টি টুরিস্ট রিজোর্ট এবং সিটি স্টেট (মাকাও, মনাকো, সিঙ্গাপুর, হং কং, জিব্রাল্টার, ভ্যাটিকান, মাল্টা, এবং বারমিউদা) বাদ দিলে, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ দেশ। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে (জলভাগ সহ) এগারো শ’রও বেশি লোক বাস করে। যেখানে সমপরিমাণ জায়গায় গোটা পৃথিবীতে জন বসতির গড় ঘনত্ব মাত্র ১৩ জন। বাংলাদেশে সর্বমোট জমির পারমাণ ১ লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে স্থল ভাগ ১ লক্ষ ৩০ এবং জলভাগ ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত পরিবেষ্টিত ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটার বাদে, স্থল ভাগের অবশিষ্ট থাকে ১ লক্ষ ১৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
তা থেকে আবার বসত বাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, এবং হাটবাজার বিয়োগ করলে, আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১ কোটি ৭৩ লক্ষ হেক্টর। সামান্য এ জমিটুকুই বাংলাদেশের সোনা। এখানে ফলে সোনার ফসল যা খেয়ে বেঁচে আছে ১৬ কোটি মানুষ। কিন্তু সমস্যা হলো এই ১ কোটি ৭৩ লক্ষ হেক্টর আবাদি জমি বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারছে না। কিছু আবাদি জমি প্রতি বছর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও
নগরায়নের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত হচ্ছে। নদীভাঙনে যে জমি নষ্ট হয় তার কিছুটা অন্তত চর উঠলে ফিরে পাওয়া যায়। তাছাড়া নদী ভাঙন রোধ করার তেমন কোনো কার্যকর প্রযুক্তি আপাততঃ বাংলাদেশের হাতে নেই, কিন্তু বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, ও নগরায়নের জন্য যেটুকু কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে, তা ঠেকানোর উপায় আছে, এবং এটাই এ নিবন্ধের আসল উদ্দেশ্য।

পাবনার আটঘরিয়া কলেজের অধ্যাপক জাফর সাদেক তাঁর এক সাম্প্রতিক গবেষণায় এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭১-৮৭ এ ১৬ বছরে বাংলাদেশ তার মূল্যবান আবাদি জমি হারিয়েছে ১৪ লক্ষ হেক্টর। জাফর সাদেকের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ওই সময়ে গড়ে প্রতি বছর সাড়ে ৮৭ হজার হেক্টর করে আবাদি জমি কৃষকদের হাতছাড়া হয়েছে। তাঁরই আরেক হিসেব মতে, নদীভাঙন বাদ দিলে, বর্তমানে বসতবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, ও শিল্পকারখানাজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন ২১৩ হেক্টর কৃষি জমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই হারে বছরে হারিয়ে যাওয়া কৃষি জমির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৭৭ হাজার হেক্টরের ওপরে। বাংলাদেশ উনড়বয়ন পরিষদের এক রিপোর্টে এটা ৮০ হজার হেক্টর ধরা হয়েছে। এ দুই হিসেবে একটু গড়মিল থাকলেও খুব একটা ফারাক নেই। দু’টোর গড় ধরলে, পরিমাণটা দাঁড়াচ্ছে সাড়ে ৭৮ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ প্রতি বছর এ পরিমাণ জমি কৃষি খাত থেকে চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। এ ধারা জারি থাকলে আগামী শতাব্দীর কোনো এক সময় বাংলাদেশে আবাদ করার মত কোনো ফসলি জমি অবশিষ্ট থাকবে না। ততদিনে লোকসংখ্যা হয়ত ৩০ কোটিতে গিয়ে স্থিতিশীল হবে। বেঁচে থাকতে হলে, প্রয়োজনীয় খাদ্য শষ্যের ষোল আনাই তখন বিদেশ থেকে আমদানী করতে হবে। চিত্রটি বস্তুতই ভয়াবহ! তাই সময় নষ্ট না করে, ঘর বাড়ি, রাস্তাঘাট, কল কারখানা, ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বাবত বছর বছর যে বিপুল পরিমাণ জমি কৃষি খাত থেকে অকৃষিতে চলে যাচ্ছে, তা কার্যকরভাবে দ্রুত কমিয়ে আনা উচিৎ।
কাজটি যত গুরুত্ত্বপূর্ণ এবং জরুরি, তত ব্যয়বহুল, কঠিন, ও বিরাট। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৭০ হাজার গ্রামকে μমানড়বয়ে ভার্টিক্যাল ভিলেজে রূপান্তরিত করে শুধু জমি সংরক্ষণই নয় বরং উল্যেখযোগ্য পরিমাণ কৃষি জমি বাড়ানোও সম্ভব। ভার্টিক্যাল ভিলেজের উদ্দেশ্য - প্রতিটা
গ্রামে এক বা একাধিক হাইরাইজ টাওয়ার বানিয়ে ছড়িয়ে থাকা আলাদা আলাদা বাড়ি থেকে গ্রামের সবগুলো পরিবারকে হাই রাইজ টাওয়ারের ছোট ছোট ফ্ল্যাটে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তুলে দেওয়া। এভাবে যুগ যুগ ধরে ঘর বাড়িতে ব্যবহৃত জমি, কৃষি কাজের জন্য সহজেই মুক্ত করে আনা যায়। এছাড়া আবাদি জমি নষ্ট করে যারা নতুন ঘর বাড়ি বানাতে চায়, তাদের জন্যও হাই রাইজ টাওয়ারে ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত রেখে তাও বন্ধ করা যায়। জাফর সাদেকের গবেষণায় আরো দেখা যায় যে গ্রামে ১০০টা পরিবার বাস করে সে গ্রামে শুধু বসতবাটির জন্য মানুষ ব্যবহার করছে ১৩০ হেক্টরের মত জমি। কিন্তু মাত্র ৩ হেক্টর জমি ব্যবহার করে, ভার্টিক্যাল ভিলেজের অধীনে সহজেই গ্রামের ১০০টা পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। এতে ১২৭ হেক্টর অনাবাদি জমি মুক্ত হয়ে যায়। যদি বছরে ১,০০০ গ্রামকে ভার্টিক্যাল ভিলেজে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে প্রতি বছর ১ লক্ষ ৩৭ হাজার হেক্টর অনাবাদি জমি আবাদি জমিতে পরিণত হবে। এখন শুরু করে এ হারে কাজ করতে পারলে, আগামী সত্তর বছরে বাংলাদেশে আর কোনো লিনিয়ার বা কংলোমারেট গ্রাম থাকবে না। সবই পরিণত হবে ভার্টিক্যাল ভিলেজে। একজন ব্যক্তির জীবনে সত্তর বছর অনেক লম্বা সময় হলেও, একটা জাতির জীবনে এটা কছুই নয়। এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য চীন, শত্রু সীমান্তে যে ঐতিহাকি প্রাচীর তুলেছিলো, তা বানাতে তাদের সময় লেগেছিলো দীর্ঘ দু’হাজার বছর।
এখন প্রশ্ন হলো ভার্টিক্যাল ভিলেজের কাজটা কী ভাবে শুরু করা যায়। এটা বিভিনড়ব ভাবে হতে পারে। তবে কাজটা আরম্ভ করা ঊচিৎ একটা পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে। পাইলট প্রজেক্টের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে ব্র্যাক বা এ ধরণের কোনো এন.জি.ও.। পাইলট পিরিওড পরে যদি দেখা যায়, ভার্টিক্যাল ভিলেজের ফলে ওই গ্রামে বা তার আশপাশ অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, এবং পরিবেশের উপর কোনো বিরূপ প্রতিμিয়া নেই, তাহলে সারা দেশে জোরেশোরে পুরো উদ্যমে ভার্টিক্যাল ভিলেজের কাজ শুরু করা যেতে পারে। পরের প্রশড়ব, টাকা কোত্থেকে আসবে? টাকার জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই.এম.এফ., এ.ডি.বি. ও দাতা দেশ থেকে গ্র্যান্ট এবং ঋণ সাহায্যের চেষ্টা করা যেতে পারে। এছাড়া দেশীয় সম্পদের উপর নির্ভর করে বার্ষিক উনড়বয়ন প্রকল্পের (এ.ডি.পি.) অধীনে, বাংলাদেশ অল্প অল্প করে তার সনাতনী লিনিয়ার ও কংলোমারেট ভিলেজগুলোকে ভার্টিক্যাল ভিলেজে রূপান্তরিত করতে পারে।
কৃষি জমি সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণ ছাড়াও, ভার্টিক্যাল ভিলেজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হ্রাসেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। রাশিয়ান সরকার তাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি একটা বিরাট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। ওই প্রজেক্টের অধীনে তারা আলাদা আলাদা বাড়ি বানিয়ে লক্ষ লক্ষ রাশিয়ান পরিবারকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাড়িতে তুলে দিচ্ছে। রাশিয়ান থিওরি হল, অ্যাপার্টমেন্টের স্বল্পপরিসর ও বন্ধ পরিবেশ ছেড়ে, বৃহৎ খোলামেলা পরিবেশে আলাদা আলাদা বাড়িতে বসবাস করলে শিশু জন্মের হার বাড়ে। রাশিয়ান থিওরি যদি বাংলাদেশের জন্য সঠিক হয়, তাহলে দেশের সব লিনিয়ার ও কংলোমারেট ভিলেজকে ভার্টিক্যাল ভিলেজে পরিণত করে বাংলাদেশ তার জনসংখ্যাকেও যৌক্তিক জায়গায় রাখতে পারে।
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
১ মে ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে