শুক্রবার, ০৬ মে, ২০১৬, ০১:৩৪:০৬

মাকে মুক্তি দিয়ে আদরের সন্তানটি চলে গেলো

মাকে মুক্তি দিয়ে আদরের সন্তানটি চলে গেলো

শাহানা হুদা: বয়স্ক শিশুটি আমাদের বিল্ডিং এর ৬ তলায় থাকতো তার মায়ের সঙ্গে। আসা যাওয়ার সময় হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেতো পথে। বাচ্চাটিকে নিয়ে ওর মা যখন চলাফেরা করতেন, তখন তাকে দেখলেই বোঝা যেতো দারুণ একটা কষ্ট বুকে চেপে আছেন। উনি খুব সন্তর্পণে, মুখ চোখ আড়াল করে বাচ্চাটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন। তাও মাঝেমাঝে তাদের শেষরক্ষা হতো না।

বাচ্চাটি লিফটের ভেতরেই পায়খানা, পেশাব করে ফেলতো। এই আমরাই সে কারণে বিরক্ত হতাম, খেদ প্রকাশ করতাম। তাই হয়তো লজ্জায় ১৭ বছরের ওই ছেলেটির মা মুখ লুকিয়ে চলতেন। প্রতিবন্ধী শিশুটির মা ছিল অসহায়, কারণ ডাক্তার বলেছিল প্রতিদিন বাচ্চাটিকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যেতে, নতুবা ও আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই এই বিরাট সংসারে শিশুটির মা-ই এই অপ্রিয় কাজটি করতে বাধ্য হতেন।

আমাদের বিল্ডিং এর সেই অবুঝ শিশুটি তার মায়ের সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে পরপারে চলে গেছে। ওর মা কাদঁতে কাঁদতে একনাগাড়ে পাগলের মত বলে চলেছেন, ‘‘ওর জন্য আমি ঘুমাতে পারতাম না । শুধু মনে হতো আমি ওকে রেখে মারা গেলে কে দেখবে ওকে? আজকে ও আমার হাতেই মাথা রেখে চলে গেল, আজকে রাতে কি তাহলে আমি ঘুমাবো!”

আমি এমন আরো একজন মাকে চিনতাম, যে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলেছিলেন, ‘‘জানিস যদি পারতাম তাহলে আমিই আমার বাচ্চাটিকে গলা চিপে মেরে ফেলতাম। কিন্তু পারিনি, পারব না। শুধু ভয় হয় আমি আর ওর বাবা না থাকলে এই সংসারে ও কোথায় গিয়ে থাকবে? ওতো তখন এমনিই মারা যাবে, কষ্ট পাবে।” এই কথাটি সে যখন বলছে তখন ঝরঝর করে করে কাঁদছে।

“অথচ কি জানিস, ওকেই আমি আমার তিন বাচ্চার মধ্যে সবচেয়ে ভালবাসি । সারাক্ষণ ওর কথা ভাবি।”

আমার এই খালাটির ওই ছেলেটিও ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছেলেটি মারা যাবার মাত্র একবছর পর ওর মা মানে আমার খালাও মারা গেলেন। ভাবনাহীন মৃত্যু হলো তার।

সেদিন ভূমিকম্পের পর কে কী করছিল, এই আলোচনার সময় আমাদের একজন আত্মীয় বললেন, “আমিতো আমার অসুস্থ ছেলেটিকে রেখে কখনও কোথাও বেড়াতেও যাই না, আর ভূমিকম্পের সময় ওকে রেখে কোথায় যাবো? আমার ছেলেটি তো চলাফেরা করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে আমি ওর সাথে থাকতে থাকতে এখন নিজেও প্রতিবন্ধী হয়ে গেছি।”

যে বাবা মায়ের একটি প্রতিবন্ধী বাচ্চা থাকে, তারা জানেন কতটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়। এই দেশে এই সমাজে কী ভয়াবহ প্রতিকূলতাকে তারা মেনে নিয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানকে প্রতিপালন করেন। এদেশে যেখানে একজন সুস্থ শিশুকেই ঠিকমতো বড় করে তোলা অভিভাবকের জন্য কঠিনতম কাজ, সেখানে একজন শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চার অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

সরকারি এতিমখানা শিশুমণিদের নিবাস প্রায়ই বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিবন্ধী বাচ্চা কুড়িয়ে পায় বা পুলিশ এসে এখানে দিয়ে যায়। আর তাই ওখানে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় নিয়মিতই সেখানে ৩/৪টি প্রতিবন্ধী শিশু আছে এবং টিকেও আছে ওদের সেবা যত্নে। এই বাচ্চাগুলো শুধু অযাচিতই নয়, ভীষণভাবে অযাচিত। ওদের মা বা বাবা প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকত্ব অস্বীকার করে তাদের ফেলে রেখে যায় জলে, জঙ্গলে বা পথের ধারে।

আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষই মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষকে ‘পাগল’ বলে মনে করে এবং সেভাবেই তার সাথে আচরণ করে। স্কুলগুলোতে ভিন্নভাবে সক্ষম এসব শিশুদের জন্য নেই কোন বিশেষ ব্যবস্থা, বিশেষ সুবিধা। যাও দু’একটা স্কুলে আছে, তাও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুব অপ্রতুল। সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষকরাও এদের পরিচালনা করার ব্যাপারে ঠিকমত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নন। আর তাই যা হওয়ার তাই হয়।

এসব শিশু প্রায় সব ধরণের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাবা, মা ছাড়া বিশেষ করে মা ছাড়া কেউ তাদের খোঁজ রাখে না, যত্ন করে না, ভালবাসে না। এদেরকে সবাই মনে করে পরিবার বা সমাজের বোঝা হিসেবে। একজন অসৎ, বদমাশ, লম্পট, খুনিকে সমাজ যতটা না এড়িয়ে চলে, এর চেয়ে বেশি এদের এড়িয়ে চলে। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরাও একইভাবে অবহেলিত, অনাদৃত। শহরে, মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারে যদিও এই মানুষগুলোর কিছুটা মূল্য রয়েছে, তাদের কথা তাদের পরিবার কিছুটা হলেও ভাবে; কিন্তু দরিদ্র পরিবারে এরা শুধুই বোঝা।

অনেককেই ব্যবহার করা হয় ভিক্ষাবৃ্ত্তিতে। তবে যেকোন পরিবারেই এই অসহায় মানুষগুলো যতদিন বাঁচে, ততদিনই থেকে যায় সংসারের বোঝা হিসেবে। শুধু তাদের মা বা বাবাই তাদের কথা ভাবে, তাদের ভালোবাসে। তবে রাষ্ট্র যদি সত্যিকারভাবেই এদের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে পরিবারের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হতে পারে। যেমনটা হয়েছে উন্নত বিশ্বে।

আমাদের একটু ভালবাসা, একটু সমর্থন, দৃষ্টিভঙ্গীর একটু বদল, একটু উদারতা, একটু হাত বাড়িয়ে দেয়া বেঁচে থাকার শক্তি যোগাতে পারে--- এই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলোকে। এরাতো আমাদেরই সন্তান, ভিনগ্রহের কেউ নয়। আমাদের সবার ভাবা উচিৎ যেকোন সময়ে, যে কারো সংসারে এমন একটি শিশুর জন্ম হতে পারে, যে সাদা চোখে অক্ষম কিন্তু যে হতে পারে ভিন্নভাবে সক্ষম। এদের প্রত্যকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিভিন্ন ধরণের শক্তি, যাকে জাগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব এই আমাদেরই। -চ্যানেল আই
৬ মে ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে