এনাম আবেদীন: প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ঘুরে দাঁড়ানোর মতো ন্যূনতম রাজনৈতিক কর্মকৌশল নেই বিএনপিতে। বরং কাউন্সিলের পর দলটির নেতারা পদ-পদবি বাগাতে তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দলের নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে স্থায়ী কমিটিসহ দলটির সিনিয়র নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে দূরে সরে আছেন। তাঁরা বলছেন, যাকে খুশি তাঁকে দিয়ে খালেদা জিয়া দল চালাক। কেউ কেউ আবার অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ ও চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের দিকে। কারণ শিমুলের কর্তৃত্বে গুলশান আর রিজভীর কর্তৃত্বে নয়াপল্টন কার্যালয় চলছে বলে দলে আলোচনা আছে।
সব মিলিয়ে শিমুল-রিজভীর পক্ষে-বিপক্ষে দুটি অংশ এবং লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান সমর্থকরা মিলে নানা মেরুতে বিভক্ত এখন দলটি। একটি অংশ এখন দুই কার্যালয় থেকে শিমুল ও রিজভীকে সরাতে তৎপর। পক্ষান্তরে দুই কার্যালয়ের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মরিয়া ওই দুই নেতাও। গত কয়েক দিনে এ নিয়ে সৃষ্ট অস্থিরতায় রুষ্ট হয়েছেন খালেদা জিয়া নিজেও। পদ-পদবি বা যেকোনো বিষয়ে কেউ কথা বললেই তিনি খেপে যাচ্ছেন।
অনেকের মতে, কাউন্সিলের পর কমিটি গঠনে সময় বেশি নেওয়ার কারণেই দলে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর আগে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর মাত্র ২২ দিনের মধ্যে প্রায় সব পর্যায়ের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সবার আগে ঘোষিত হয়েছিল মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পদ। কিন্তু এবার প্রথমে মহাসচিবের নাম ঘোষণা হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটি গত দেড় মাসেও দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি অন্যান্য পদ ঘোষণার ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্য রক্ষা করা হয়নি। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দ্বন্দ্ব।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, বিএনপির মতো বড় দলে পদ-পদবি নিয়ে একটু-আধটু ঝগড়াঝাঁটি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ এ দলের নেতারা অনেক দিন ধরে বঞ্চিত হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে কিছু পাওয়া বা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। তাই আমিও বলব, এখনই এসব ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে বিএনপি নেতৃত্ব জাতীয় সংকট সমাধানের বিষয়ে আত্মনিয়োগ করলে ভালো হয়। তা না হলে দলের ক্ষতি হবে। অবশ্য মে মাসের মধ্যে সব পর্যায়ের কমিটি ঘোষণার পর দলে গ্রুপিং-লবিং বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিএনপিপন্থী এই বুদ্ধিজীবী।
স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। সরকারের ব্যর্থতায় জনগণ হতাশ। ব্যাংকের রিজার্ভ পর্যন্ত লুট হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় স্বার্থে রাজনীতি নিয়েই বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত বিএনপির। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দ্রুত অবশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে জাতীয় স্বার্থে কর্মসূচি দিয়ে জনগণের পক্ষে অগ্রসর হওয়া সমীচীন বলে আমি মনে করি।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যাঁরা বড় কিছু হতে চান এমন নেতাদের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে অস্থিরতা থাকতে পারে। কারণ যোগ্যতার তুলনায় প্রত্যাশা তাঁদের বেশি বলেই এমনটি হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রিজভী আহমেদ সংবাদ পাঠক। তাঁকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়, তিনি তাই পাঠ করেন। এমনকি ওই পাঠে যদি তাঁর নিজের বিরুদ্ধেও কিছু যায়, তাও তাঁকে পাঠ করতে হবে। সম্ভবত এই পাঠ করা নিয়েই পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে দুজন দল চালাচ্ছেন। কিন্তু কমিটি গঠনে তাঁদের (রিজভী-শিমুল) আদৌ কোনো প্রভাব আছে বলে মনে হয় না।’ তাঁর মতে, ৩৩ বছর যাবৎ খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্বে আছেন। তাই তিনি কম-বেশি সবাইকে চেনেন। তিনি চেনেন না এমন কেউ এ পর্যন্ত কমিটিতে স্থান পায়নি।
সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহানের মতে, প্রশিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী বাহিনী হলো একটি দলের প্রাণশক্তি। আর এই প্রশিক্ষণ নিতে হয় রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে এ বিষয়টি অনুপস্থিত। আর চেতনায় এ ঘাটতির কারণেই নেতাকর্মীরা পদ-পদবি নিয়ে লড়াইয়ে ব্যস্ত। তাঁর মতে, কাউন্সিলের পর এই প্রতিযোগিতা আরো বেড়েছে। তবে অবশ্যই এই গ্রুপিং-লবিংয়ের সীমা থাকা উচিত। পদ-পদবির কারণে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া হবে দুর্ভাগ্যজনক। ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে এখন বিএনপিকে মনোযোগী হতে হবে। তা না হলে সামনে কঠিন সময় আসতে পারে।
সূত্র মতে, সিনিয়র নেতাদের ক্ষোভের বড় কারণ কাউন্সিলের পর কমিটি গঠনে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। বরং স্থায়ী কমিটিতে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি নিয়েই দলে নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাঁরা জানতে পেরেছেন, স্থায়ী কমিটি আগে হয়ে গেলে ওই নেতারা অন্যান্য কমিটি গঠনে প্রভাব বিস্তার করবেন এমন ধারণা চেয়ারপারসনকে দেওয়া হয়েছে। ফলে কাউন্সিলের দেড় মাস অতিক্রান্ত হলেও ঘোষণা করা হয়নি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ওই কমিটি।
স্থায়ী কমিটির নেতারা এ কারণে অসম্মানিত বোধ করছেন। খালেদা জিয়া না ডাকলে তাঁরা গুলশান কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। মধ্যম সারির পাশাপাশি পদবঞ্চিত ও পদপ্রত্যাশী নেতারাই এখন প্রতিদিন সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন। কুশল বিনিময়ের অজুহাতে খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। কেউ কেউ শিমুল বিশ্বাসকে খুশি করার চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার শিমুল ও রিজভীর সমালোচনাও করছেন। পদের আশায় সামনের সড়কে গত কয়েক দিনে শোডাউন করতে দেখা গেছে অনেককে। অন্যদিকে পদবঞ্চিতরা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন লন্ডনে। তারেক রহমানের কাছে সুবিচার চেয়ে অনেকেই প্রতিপক্ষ নেতাদের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি পাঠিয়েছেন। তারেক সমর্থক কোনো নেতাকেই এ পর্যন্ত ঘোষিত কমিটিতে রাখা হয়নি। ফলে এ নিয়ে মা ও ছেলের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছে একটি সূত্র। আর এতেই কমিটি ঘোষণা কিছুদিনের জন্য আটকে গেছে।
সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতির এ সুযোগে গুলশান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব পূর্ণ মাত্রায় শিমুল বিশ্বাসের কবজায় চলে গেছে বলে অভিযোগ উঠছে। আর নয়াপল্টন কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রিজভী আহমেদের হাতে। তিনি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হলেও দপ্তর সম্পাদকের পদ ছাড়েননি। অথচ ১৯ মার্চ কাউন্সিলে দলের গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি সংযোজিত হয়েছে। ওই নীতির কারণে মহাসচিব হওয়ার পর কৃষক দলের সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতির পদ ছেড়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু রিজভী আহমেদ তা না করায় দলের বড় একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ফলে অন্য নেতারাও বলছেন, একাধিক পদ থাকলেও তাঁরা তা ছাড়বেন না। স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য তরিকুল ইসলামসহ শুভাকাঙ্ক্ষী বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে রিজভীকে দপ্তর সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে টানা ৯ বছর সাত মাস ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। এর আগে ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ খালেদা জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত দলটি আট বছর ১১ মাস ২৪ দিন ক্ষমতার বাইরে ছিল। কয়েক দফা সরকারবিরোধী ব্যর্থ আন্দোলনের পর দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি বর্তমানে বেশ বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
আন্দোলন করতে গিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলা-হামলার শিকার হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো। ওই কাঠামো ঠিক করার জন্যই জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া। কিন্তু গত দেড় মাসে মহাসচিবসহ মাত্র ৪১টি পদ ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে দলে নানামুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ খালেদা জিয়ার সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আর যেসব পদে কমিটি ঘোষণা বাকি আছে, তা নিয়েও দলে অস্থিরতা চলছে। পরস্পরবিরোধী নেতারা এখন একে অন্যের চরিত্র হননে মাঠে নেমেছেন। শুধু তাই নয়, কে কোথায় দুর্নীতি করেছেন বা কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে পরস্পরবিরোধী নেতারা এখন তা হন্যে হয়ে খুঁজছেন।
কিভাবে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে, দলের কর্মকৌশলই বা কী হবে সে বিষয়ে আলোচনা দূরে থাক, চিন্তাও বিএনপিতে নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হতে পারে বলে দলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে অথচ এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা নেই। অনেকের মতে, পদ-পদবি নিয়ে বিরোধ এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে খালেদার সাজা হওয়ার পর একটি বিক্ষোভ মিছিল করার মতো পরিস্থিতি থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে দল কিভাবে চলবে সে বিষয়ে দলটির ভেতরে শঙ্কা থাকলেও আলোচনা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা বা অন্য কোনো বিপর্যয় হলে পদ-পদবি নিয়ে ব্যস্ত নেতাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ এখনকার তৎপরতা দেখলে মনে হয় তাঁরাই দল চালাচ্ছেন এমনটি বলেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ ওই নেতা।
জানা গেছে, ঘোষিত কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া নেতাদের পাশাপাশি বঞ্চিতরাও ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে অবস্থান নিয়েছেন। ভালো পদ পাওয়া নেতারা শিমুল ও রিজভীর বিরুদ্ধে বেশি কথা বলছেন না। অন্যদিকে, বঞ্চিত নেতারা সরাসরি ওই দুজনকে দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, কমিটিতে সিনিয়রদের কোনো অবদান নেই। এমনকি তারেক রহমানের সমর্থক নেতাদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে একাট্টা হয়ে তাঁরাও এখন শিমুল ও রিজভীর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন।
একটি সূত্রের দাবি, সাম্প্রতিককালে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ নিয়ে অভিযোগ ওঠায় একটি পক্ষ আবার এক হয়েছে শিমুল ও রিজভীর সমর্থনে। কারণ ওই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তাঁদের সবারই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। শিমুল-রিজভী এখন একাট্টা বলে বিএনপির বেশির ভাগ নেতাকর্মী মনে করে।-কালের কন্ঠ
৭ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ