শনিবার, ০৭ মে, ২০১৬, ০৬:৩৭:৫০

ফেসবুকে বিদেশি বন্ধু, উপহারে প্রতারণা ফাঁদ!

ফেসবুকে বিদেশি বন্ধু, উপহারে প্রতারণা ফাঁদ!

এস এম আজাদ: মোবাইল ফোন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রথমে যোগাযোগ করে ওরা। নিজেদের ইউরোপ বা আমেরিকার নাগরিক বলে পরিচয় দিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এরপর কখনো কুরিয়ারের পার্সেলে উপহার পাঠানোর ‘খরচ’ পরিশোধ করতে অনুরোধ করে। আবার কখনো ‘বন্ধুকে’ জানায়, কয়েক পাউন্ড বা ডলারের পুরস্কার পেয়েছে সে।

আর এই পুরস্কার গ্রহণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ‘খরচ’ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানোর অনুরোধ করে এই ‘বিদেশি বন্ধুরা’। মোবাইল ফোনে ও ফেসবুকে মেসেজ দেওয়ার পাশাপাশি তারা ই-মেইল ঠিকানা নিয়ে সেখানে বার্তা পাঠাতে থাকে। এমন উপহার ও পুরস্কারের লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েছে অনেকে। মূলত উপহার বা পুরস্কার নয়, এসব বিদেশি বন্ধুর আসল উদ্দেশ্য হলো প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া।

বিদেশি নাগরিক পরিচয়ে প্রতারণাকারী চারটি চক্রকে গ্রেপ্তারের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দারা। যারা অনলাইনে বন্ধুত্ব গড়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা ইউরোপিয়ান, আমেরিকান নয়, সবাই আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ারই নাগরিক। লেখাপড়া বা ব্যবসার নামে বাংলাদেশে এসে তারা এই অভিনব প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে। তাদের ফাঁদে পড়ছে চিকৎসক, ব্যবসায়ীসহ উচ্চশিক্ষিতরাও। তবে চক্রগুলোর প্রধান লক্ষ্য নারী। চারটি মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাইজেরিয়ান এই প্রতারকচক্রকে সহায়তা করছে বাংলাদেশি কিছু তরুণ, তরুণী। গত দুই মাসে এমন প্রতারণার অভিযোগে ১২ জন নাইজেরিয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব ঘটনায় আট বাংলাদেশিও ধরা পড়ে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীর উত্তরা ও বনানী এলাকায় অভিযান চালিয়ে নাইজেরিয়ান ওজোমিনা নোনসো মারভিন ইকেসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলো সোনিয়া শারমীন, নুসরাত জাহান, জাহনা বেগম লাভলী, ঈদ্রিস আলী। ডিবির উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ওজোমিনা নোনসো মারভিন ইকে বাংলাদেশে গার্মেন্ট ব্যবসার কথা বলে অনুপ্রবেশ করে। সে নিজেকে ব্রিটিশ ও আমেরিকান পরিচয় দিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। পরিচয়ের সূত্র ধরে ‘গিফট’ পাঠানোর নাম করে মেয়েদের ঠিকানা সংগ্রহ করে। পরবর্তী সময়ে পার্সেল এসেছে এবং তা খালাস করতে কিছু টাকা লাগবে বলে অনুরোধ জানায়।

শেখ নাজমুল আরো জানান, এই চক্র কখনো বন্ধুদের গিফট পাঠানোর পর বলে বিমানবন্দরে স্ক্যানিং মেশিনে কিছু গোল্ড ও পাউন্ড আটকা পড়েছে। পার্সেলে প্রাপক-প্রেরক হিসেবে তার ও বন্ধুর নাম লেখা আছে। তাই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। এই ভয় দেখিয়ে শুল্ক দিয়ে চালানটি খালাস করার কথা বলেও টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়া মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে এবং নানা কায়দায় প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়।

এদিকে গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর শাহ আলী এলাকা থেকে মোহাম্মদ আউয়ালু আদামু, ওবায়দুবাহিমেন, ওলোনোফেমি ডানিয়েল, মো. আদামু নামে চার নাইজেরিয়ান শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যরা। তাদের সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশি তরুণী চয়ন আরা রিয়াকেও গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারকৃত চার নাইজেরিয়ান ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ (এসএস) আহসান হাবীব পলাশ বলেন, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতারিত এক ব্যক্তি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে পল্টন থানায় একটি মামলা করেন। এ ঘটনার তদন্তে নেমেই চক্রটিকে শনাক্ত করা হয়। তাদের কাছ থেকে চারটি ল্যাপটপ, আটটি মোবাইল, ব্যাংকের চেক ও অ্যাকাউন্ট তথ্য, সিম ও পেনড্রাইভ জব্দ করা হয়। প্রতারণার শিকার এক ব্যক্তিকে চক্রটি বলেছিল, তিনি কয়েক পাউন্ড ও ডলারের কোকা-কোলা পুরস্কার পেয়েছেন। এরপর তাঁর কাছ থেকে কয়েক দফায় ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা টাকা আত্মসাৎ করে। তিনি শেষে বুঝতে পেরে মামলা করেন। বাংলাদেশি কয়েকজন যুবক ও তরুণীর যোগসাজশ থাকায় প্রতারণায় সুবিধা পাচ্ছে প্রতারকচক্রটি।

আহসান হাবীব পলাশ আরো জানান, নাইজেরিয়ানরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসএমএস বা ই-মেইলের মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার (স্ক্যাম) মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত বলে প্রচার আছে। আউয়াল আদামুও আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের একজন সদস্য। তার মতো আরো কয়েকজন বাংলাদেশে সক্রিয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সংঘবদ্ধ এসব চক্র মোবাইল ফোন ব্যবহার করে গ্রাহকদের কোকা-কোলা লটারি, ইউনাইটেড ন্যাশন্স পুরস্কার, আইসিটি টুর্নামেন্ট পুরস্কার, ইউএনডিপি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পুরস্কার জেতার বার্তা দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল।

তারা প্রথমে ফেসবুক, মোবাইল ফোন ও ই-মেইল আইডিতে এই বার্তা পাঠায়। প্রতারণার শিকার  ব্যক্তিদের কাছ থেকে কাস্টমস ডিউটি, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা ছাড়, মানি লন্ডারিং মামলায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ভীতি, ফিসিং (ভুয়া ওয়েব পেজ), সিওসি (কস্ট অব ট্রান্সফার) শতকরা পাঁচ ভাগ ভ্যাটসহ বিভিন্ন খাতের কথা বলে টাকা আদায় করছে। প্রতারকরা যে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণা করছিল তার অন্তত ছয়টি ব্যাংক হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেছে। এসব হিসাব বাংলাদেশিদের নামেই খোলা হয়।

পিবিআইয়ের পরিদর্শক আ. রাজ্জাক জানান, স্টুডেন্ট ভিসায় কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে আসে আদামু। বিপ্লব লস্কর নামে এক দাগী অপরাধীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বিপ্লব লস্কর একটি মামলায় বগুড়ায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছে। বিপ্লব ছাড়াও আদামু বাংলাদেশি দল গঠন করে। এ দলের মাধ্যমে প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বরে পুরস্কার, নগদ অর্থ জেতার ঘোষণাসংক্রান্ত একটি মেসেজ পাঠাত সে।

এরপর ওই মেসেজের সঙ্গে একটি ই-মেইল আইডির লিংক পাঠাত। ওই মেসেজ পেয়ে যারা যোগাযোগ করত তাদের কাছ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ছবি, ই-মেইল আইডিসহ বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হতো বিশ্বাস স্থাপন করতে। যারা ইংরেজি বুঝত না তাদের সঙ্গে এ চক্রের নারী সদস্যরা যোগাযোগ করে বাংলায় কথা বলত। 

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশান ও নিকেতন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নাইজেরিয়ার নাগরিক ইজুচিউ ফ্রাংকিন, অবি হেছি ও ইক ফ্লিস্ক এবং মোহাম্মদ আলী, মঞ্জুর মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব-২-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মিজানুর রহমান বলেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল তরুণ-তরুণীকে অভিনব পন্থায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে চক্রটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্রিটিশ নাগরিক ডেসমন্ড বি সামুয়েল পরিচয়ে সখ্য গড়ে তোলে চক্রের সদস্যরা। গত ১০ ফেব্রুয়ারি মিন-রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে (নম্বর-০১৭৪৭২৬৪১০১) ওই চিকিৎসককে জানানো হয়, ইংল্যান্ড থেকে তাঁর নামে একটি গিফট বক্স এসেছে। কুরিয়ার ফি দিতে হবে ৫৬ হাজার ৫৬৬ টাকা।

১১ ফেব্রুয়ারি ওই টাকা কুরিয়ারের ব্যাংক হিসাবে (নম্বর-০০১০১৭৮০৯) সোনালী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় জমা দেন তিনি। ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে আবারও জানানো হয়, গিফট বক্স স্ক্যান করে দেখা গেছে তাতে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের হিরার গহনা রয়েছে। তাই তাঁকে দুই লাখ ৬২ হাজার ৯০০ টাকা দিতে হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই চিকিৎসক টাকা কুরিয়ারে ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। ওই দিনই বিকেলে তাঁকে আবারও জানানো হয়, গিফট বক্সে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকায় তাঁকে আরো ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। তখন তিনি গিফট বক্সের অবস্থান জানতে চাইলে পরে জানানো হবে বলা হয়।

এতে ওই চিকিৎসকের সন্দেহ হয়। তিনি র‌্যাবকে পুরো ঘটনাটি জানান। এএসপি মিজানুর রহমান আরো জানান, তিন বছর ধরে গার্মেন্ট ব্যবসার আড়ালে বাংলাদেশে অবস্থান করে প্রতারণা করে যাচ্ছিল তিন নাইজেরিয়ান।

র‌্যাব সূত্র জানায়, পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে পরে আরো চার নাইজেরিয়ানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এই চক্রও একই পন্থায় প্রতারণা করছে, যাদের কয়েক সহযোগী এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী চিকিৎসক এবং খুলনার এক ব্যাংক কর্মকর্তা চক্রটির প্রতারণার শিকার হয়েছেন।-কালের কন্ঠ

৭ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে