রুকনুজ্জামান অঞ্জন : রপ্তানি বাড়াতে এরই মধ্যে ভারত ও চীন একাধিকবার নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। পাশ্যর্বর্তী দেশগুলোর এ ধরনের নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের টাকার মান কমাতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। দেশের অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে টাকার মান কমানোর বিকল্প নেই। এদিকে গত বছর থেকেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়ন ঘটছে ইউরোপীয় দেশগুলোর একক মুদ্রা ইউরো এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের। বিশেষ করে ইউরো জোনে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমার পর এ বিষয়ে সরকারের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
এ অবস্থায় টাকার মান কমানোর বিষয়ে সরকারের করণীয় নির্ধারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মাহবুব আহমেদ আজ সচিবালয়ে বৈঠক করবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের কর্মকর্তারা বলছেন, 'মুদ্রা বিনিময় হারের পার্থক্যের কারণে ইউরো জোনে আমাদের দেশের কতিপয় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও আলোচনা চলছে।
গত অর্থবছরের শুরু থেকেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থির ছিল। সম্প্রতি কিছুটা অবমূল্যায়ন ঘটেছে স্থানীয় এই মুদ্রাটির। অর্থাৎ মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, টাকার মান আরও কমা উচিত। বাংলাদেশে টাকার মান কমানো-বাড়ানোর ওপর সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না। ২০০৩ সাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার-টাকার বিনিময় হার ঠিক করে দিত। সে দরেই ডলার লেনদেন হতো।
কিন্তু এর পরও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় টাকা-ডলারের বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করেছে। ডলার কেনা-বেচা করে দর নির্ধারণে পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, ডলারের বিপরীতে যেখানে চীন, ভারতসহ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটছে, সেখানে বাংলাদেশি টাকার মান স্থির রয়েছে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিশালী মজুদের কারণে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দিয়ে প্রায় সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যায়। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় রিজার্ভের এই স্ফীতি ঘটছে। তবে এর পরও সময় সময় ডলার কেনা-বেচা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মান ধরে রাখে বলে সূত্রগুলো জানায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৭৭ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ৮০ পয়সায় ওঠানামা করেছে। গত সপ্তাহ থেকে সেটি কিছুটা বেড়ে ৭৭ টাকা ৮২ পয়সা থেকে ৮৪ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। অনলাইনগুলো সোমবার প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৭৭ টাকা ৮৪ পয়সা দেখিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, চলতি মাস থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
তবে চীন ও ভারতের মুদ্রার মান কমছে এর চেয়ে বেশি হারে। ১১ আগস্ট চীন সরকার ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করে প্রায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ। এটি ২১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ভারতের রুপির মান জানুয়ারির তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।
প্রতি ডলারের বিপরীতে ৬৪ টাকা থেকে ৬৮ টাকা হয়েছে গত মাসে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশের রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি সালাম মুর্শেদি বলেন, 'রপ্তানিমুখী শিল্প নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। আমাদের মূল্য সক্ষমতা কমে গেছে। পাশর্বর্তী দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত ও চীন, তারা নিজেদের মুদ্রার অবমূ্যল্যায়ন করে সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা সে সুযোগ পাচ্ছি না। সরকারের উচিত আমরা রপ্তানি করে যে মূল্য পাই সেটির জন্য ডলারের একটি বিশেষ হার নির্ধারণ করা।'
টাকার মান নিয়ে ৩০ আগস্ট রাজধানীতে একটি সেমিনার করেছে বেসরকারি সংস্থা ফিনান্সিয়াল এঙ্েিলন্স লিমিটেড। 'ডিভ্যালুয়েশন অব ইউয়ান, গোল্ড অ্যান্ড ফুয়েল প্রাইস ফল : ইমপ্যাক্ট অন বাংলাদেশ' শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টাকার মান কমানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্থনীতিতে অতিরিক্ত তারল্যের মতোই ক্ষতিকর।
একই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য প্রফেসর শামসুল আলম বলেন, রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে এখনই টাকার মান কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্য এখন কমছে, তাই টাকার অবমূল্যায়ন করলে আমদানিকারকদের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা নেই। এ পরিস্থিতিতে বরং রপ্তানি খাতের লাভের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার।-বিডিপ্রতিদিন
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে