মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬, ১২:৫৭:২৩

এক ভোটে কারণে জীবন গেলো ৮৪ জন

এক ভোটে কারণে জীবন গেলো ৮৪ জন

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি: চার ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৮৪ জনের। এদের ৪৫ জনই আওয়ামী লীগ সমর্থক। বিএনপির সমর্থক ৩ জন। তা ছাড়া ইউপি সাধারণ সদস্যসহ ভোটার মারা গেছেন ৩৬ জন। তাদের বড় অংশেরই রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে মহিলা ও শিশুও রয়েছে। চার দফা ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা যান ১৫ জন। এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ইউপি ভোটকে কেন্দ্র করে মৃত্যুর ঘটনার কোনোটিরই এখন পর্যন্ত তদন্ত শুরু হয়নি।

এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশনও ‘নিশ্চুপ’ রয়েছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা পালন করছে। কোনো পক্ষই দায় নিচ্ছে না। ইউপি নির্বাচনের সহিংসতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম ধাপের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনের আগে-পরে ও নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ হয়। নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধের পরিণামেই ৮৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন কমপক্ষে ৭ হাজার। প্রাণহানির তথ্য পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, প্রথম ধাপের নির্বাচনের আগে ১০ জন, প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন ১১ জন, প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর থেকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ১১ জন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন ৯ জন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর থেকে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ১৭ জন এবং তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন ৫ জন মারা যান। এ ছাড়া তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের পর দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত সহিংসতায় ২০ জনের মৃত্যু হয়।

স্থানীয় সরকার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রতিটি ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। যে বা যারাই দোষী হোন না কেন, তাদের বিচারের মুখোমুখি করাতে হবে। নইলে সামনের সব নির্বাচনেই এ ঘটনার মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে পূর্বশত্রুতার জেরও নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে নির্বাচনী সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার দায় ব্যক্তিদ্বন্দ্বের ওপর চাপিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সংঘর্ষ ও হামলা ঘটেছে তা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ঠিকমতোই দায়িত্ব পালন করেছে।’ এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘নির্বাচনী সহিংসতার পেছনে কারও গাফিলতি রয়েছে কিনা খতিয়ে দেখব আমরা।

এ ছাড়া কেন সহিংসতা হলো তা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দেখবে।’ তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার দায় কেউ নিচ্ছে না। কিন্তু এভাবে নির্বাচনের নামে সহিংসতা ও অনিয়ম চলতে পারে না।’ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘৮৪ জনের প্রাণহানি ঘটল, সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিশ্চুপ। কেউই কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিকের ব্যাপারে সরকার যত তত্পর, অথচ দেশে এতগুলো মানুষ মারা গেল তা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তাভাবনাই নেই। আমি মনে করি, প্রতিটি মৃত্যুরই সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার হওয়া উচিত। নইলে এভাবে মানুষ মারা গেলে, দুর্বৃত্তরা আরও উৎসাহিত হবে। যেহেতু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাই তাদের চুপ থাকলে চলবে না।

আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিতে হবে।’ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই রাজনৈতিক উত্তাপ দেখা যায়। প্রথম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২২ মার্চ। অনুসন্ধান ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে কাজ করা নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন ও ব্রতীর প্রাথমিক প্রতিবেদনে সহিংসতা ও হতাহতের চিত্র উঠে এসেছে।

২৩ ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীর হলদিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে নিজ দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে নিহত বশির উদ্দিন আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলেন। ৭ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফলের আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে আশরাফ ফকির নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী এবং ৮ মার্চ পিরোজপুরের নাজিরপুরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে শামসুল হক নামে একজন বিএনপি কর্মী নিহত হন।

১০ মার্চ ভোলা সদরের চর সামাইয়া ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে নিহত হন সিরাজুল ইসলাম। ১৩ মার্চ কিশোরগঞ্জের মহিন্দর ইউনিয়নে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে সোহেল মিয়া নিহত হন। ১৪ মার্চ বগুড়ার শিবগঞ্জের বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে নিহত হন মাহতাব আলী, যিনি এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে পরিচিত।

১৬ মার্চ বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের ভাসানচর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে নিহত হন সমীর চারু। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক। ১৭ মার্চ যশোরের মনিরামপুরের চালুয়াহাটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে মনসুর আলী নামে একজন নিহত হন। তিনিও আওয়ামী লীগ সমর্থক। ১৮ মার্চ পাবনার বেড়ার ঢালাইচর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সঙ্গে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে গহের উদ্দিন নামে একজন আওয়ামী লীগ সমর্থক নিহত হন। ২০ মার্চ বান্দরবানের রুমার গ্যালাইঙ্গা ইউনিয়নে জেএসএসের সঙ্গে অজ্ঞাতনামা একটি পক্ষের সংঘর্ষে জেএসএসের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী শান্তিহা নিহত হন।

প্রথম ধাপে ২২ মার্চ ইউপি নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ধানিসাফা ইউনিয়নের মোহাম্মদ সোহেল, শাহাদাত হোসেন, কামরুল মৃধা, বেলাল ও সোলাইমান নামে একসঙ্গে ৫ জন নিহত হন। তারা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। একই দিনে কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে শফিকুল আলম নামে একজন নিহত হন। একই ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ভাই আবদুল গফুর নামে একজন নিহত হন।

ঝালকাঠি সদরের নবগ্রাম ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে কাশেম শিকদার নামে একজন নিহত হন। সিরাজগঞ্জ সদরের জয়ানপুর ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের মারামারিতে পদদলিত হয়ে নওনাই বেগম নামে এক মেম্বার প্রার্থীর মা মারা যান। পটুয়াখালীর কালিশুরী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে হুমায়ুন মালিক নামে একজন নিহত হন। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক ছিলেন। নেত্রকোনোর খালিয়াজুরি ইউনিয়নে পুলিশের গুলিতে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভাই আবু কাউসার নিহত হন।

২৩ মার্চ বগুড়ার সারিয়াকান্দির বোহাইল ইউনিয়নে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় আওয়ামী লগি সমর্থক জাবেদ আলী নিহত হন। একই দিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বারৈয়াঢালা ইউনিয়নে নির্বাচনী সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে হামলায় নিয়াজউদ্দিন নয়ন নামে এক যুবলীগ নেতা নিহত হন। কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নে ভোটের দিন পুলিশের সঙ্গে এক ইউপি সদস্যের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। ব্যালটবক্স ছিনতাইয়ের সময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। ওইদিন মনির আহমেদ নামে গুলিবিদ্ধ যুবক ২৩ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

২৪ মার্চ পটুয়াখালীর দশমিনার বহরমপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে শাহজাহান মৃধা নিহত হন। এলাকায় তিনি বিএনপি সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন। একই দিনে ঢাকার কেরানীগঞ্জের বিলাসপুর ইউনিয়নে এক ইউপি সদস্যের বিজয় মিছিলে হামলা হলে মেম্বার প্রার্থীর বড় ভাই জালাল মাতবর নিহত হন। ২৫ মার্চ ময়মনসিংহের ফুলপুরের ভাইটকান্দি ইউনিয়নে পরাজিত ইউপি সদস্যের হামলায় ইদ্রিস আলী নামে একজন গ্রাম পুলিশ নিহত হন। ২৭ মার্চ গাজীপুরের কালিগঞ্জে জামালপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর হামলায় বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী চিত্তরঞ্জন শীল নিহত হন।

২৮ মার্চ ময়মনসিংহের গৌরীপুরে মিছিল থেকে ফেরার পথে নাছির সরদার নামে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী নিহত হন। ৩০ মার্চ যশোর সদরের লেবুতলা ইউনিয়নে সবুজ ও ইবাদুল ইসলাম নামে দুজন আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক নিহত হন। তারা দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের আগের রাতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে নিহত হন। ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন কেরানিগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নে মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাজী শুভ নামে এক শিশু মারা যায়। যশোর সদরের চাঁচড়া ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের গোলাগুলিতে আবদুস সাত্তার বিশে নামে এক ফেরিওয়ালা নিহত হন। জামালপুরের মেলান্দহে ইউপি সদস্যের হামলায় রকিবুল ইসলাম নামে এক মেম্বারের সমর্থক নিহত হন। মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের বাঘুটিয়া ইউনিয়নে এক ইউপি সদস্যের বিজয় মিছিল থেকে হামলা চালানো হলে নমেছা বেগম নামে পরাজিত প্রার্থীর এক কর্মীর স্ত্রী নিহত হন।

মাদারীপুর সদরের ধুরইল ইউনিয়নে দুই পক্ষের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে সুজন মৃধা নামে একজন নিহত হন। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাউরিয়া ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকরা ভোট কেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালান। এ সময় পুলিশ গুলি করলে ঘটনাস্থলেই সানাউল, ইব্রাহিম ও জামাল নামে তিনজন নিহত হন।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর ১ এপ্রিল মাদারীপুর সদরের কুনিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে হাসান বেপারী নিহত হন। একই দিন যশোর সদরের শেখহাটি ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থীর বাড়িতে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা ও গুলিতে ইকবাল হোসেন নামে এক মাংস ব্যবসায়ী নিহত হন। তিনি বিএনপি সমর্থক বলে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের তিন দিন আগে তিনি আহত হন।

৩ এপ্রিল বগুড়ার সোনাতলার দিগদাইড় ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী লিটন মিয়া মারা যান। আগের দিন তিনি সংঘর্ষে আহত হন। কুমিল্লা সদরের জোড়কানন (পূর্ব) ইউনিয়নে মোক্তার হোসেন খোকন নামে একজন মারা যান। এর আগে ৩১ মার্চ ইব্রাহিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের সামনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ছিলেন খোকন। এ ছাড়া বগুড়ার সারিয়াকান্দির কালামপুর ইউনিয়নে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মজিদ নিহত হন। তিনি দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন সংঘর্ষে আহত হন।

৮ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদরে পদ্মকর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে আকামত আলী মীর নামে একজন নিহত হন। তিনি আওয়ামী লীগ কর্মী। একই দিনে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে শহীদ আলী নামে একজন নিহত হন। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। শেরপুরের শ্রীবরদীর খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নে দুই ইউপি কর্মী-সমর্থকের সংঘর্ষে হুরমুজ আলী নামে এক পরাজিত মেম্বার প্রার্থী নিহত হন।

১২ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর মিয়া নামে একজন নিহত হন। তিনি নৌকার প্রার্থীর কর্মী বলে পরিচিত। একই দিনে বান্দরবানের রুমার পাইন্দু ইউনিয়নে মংনু মারমা নামে একজন ইউপি সদস্য প্রার্থী নিহত হন। এর আগে তিনি বান্দরবান শহরে পোস্টার নিতে গিয়ে নিখোঁজ হন। পরে হোটেল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৫ এপ্রিল যশোরের মনিরামপুরের মশ্নিমনগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চেয়ারে বসাকে কেন্দ্র করে পিটুনিতে নিহত হন রাজু আহমেদ নামে একজন আওয়ামী লীগ সমর্থক।

১৬ এপ্রিল পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার জলাবাড়ী ইউনিয়নে নির্বাচনী বিরোধে আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যানের সমর্থকরা জেপি প্রার্থীর সমর্থক জসিম উদ্দিন হাওলাদার পলাশকে পিটিয়ে হত্যা করেন। মাদারীপুরের মস্তফাপুরে ইউপি নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় জুয়েল মল্লিক নামে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাতিজা নিহত হন। ১৭ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর হামলায় প্রাণ হারান ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. আসিফ (২১)। পাঁচ দিন আগে তার ওপর হামলা চালানো হয়। তিনি আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর সমর্থক ছিলেন। একই দিনে পটুয়াখালীর বাউফলের আদাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মাদবপুর গ্রামের ইউপি সদস্য প্রার্থী পরিতোষ হাওলাদারের চাচা দীনবন্ধু হাওলাদার প্রতিপক্ষ সদস্যের হামলায় নিহত হন।

১৯ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুরের প্রহ্লাদপুর ইউনিয়নে দুর্বৃত্তদের হামলায় আক্তার হোসেন খন্দকার নামে এক ইউপি সদস্য প্রার্থী নিহত হন। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। ২১ এপ্রিল রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার কাফ্রিখাল ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে আবদুল হান্নান (৩০) নামে একজন নিহত হন। তিনি আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। ২৩ এপ্রিল ভোটের দিন প্রাণ গেছে ৫ জনের। এর মধ্যে পাবনার চাটমোহরে মথুরাপুর ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এমদাদ হোসেন ইন্দা নামে এক ভোটার নিহত হন।

আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইদ্রিস মিয়া নামে আরও এক ভোটার নিহত হন। ফরিদপুরের মধুখালীর বাগাট ইউনিয়নে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাই আতিয়ার রহমান খান নিহত হন। গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর ভাই আবুল খসরু ও কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শ্রীনগর ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে সিদ্দিক মিয়া নিহত হন। ২৫ এপ্রিল মাগুরার শ্রীপুরের গয়েশপুর ইউনিয়নের বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল হালিম ও পরাজিত আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী ইউসুফ মণ্ডলের কর্মী-সমর্থকের মধ্যে সকালে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আবদুল হালিম চেয়ারম্যানের সমর্থক ও আওয়ামী লীগ কর্মী বাবলু মিয়া (৩৫) নামে একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

একই দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর (পরাজিত) সমর্থকরা উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিয়ে বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থক হযরত আলী সরদার (৫৫) নামে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করেন। তিনি আওয়ামী লীগ কর্মী। নেত্রকোনোর কেন্দুয়া উপজেলার গরাডোবা ইউনিয়নে সংঘর্ষে ইকবাল হোসেন নামে এক আওয়ামী লীগ সমর্থক নিহত হন।

২৬ এপ্রিল নোয়াখালীর হাতিয়ায় চরকিং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় আবু তাহের নামে এক আওয়ামী লীগ সমর্থক নিহত হন। ২৮ এপ্রিল কুষ্টিয়া সদরের আলামপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে মোল্লা মাসুদ করীম (লাল্টু মোল্লা) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। ৩ মে কুমিল্লার চান্দিনার মাইজখাঁর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে নিহত হন আবদুল মান্নান।

১৯ এপ্রিল সংঘর্ষে আহত হওয়া এই আওয়ামী লীগ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থীর চাচা। একই দিনে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সোহাগী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থকের সংঘর্ষে মজিবুর রহমান নামে একজন নিহত হন। তিনি আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যানের চাচা। ৪ মে মাদারীপুরের কালকিনির সাহেবরামপুর ইউনিয়নে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক আবুল কালাম (কালু শিকদার) নামে এক আওয়ামী লীগ সমর্থককে হত্যা করা হয়।

৫ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মির্জাপুর ইউনিয়নে নির্বাচনী ক্যাম্পের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে নূরে এলাহী নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। একই দিনে ঝিনাইদের হরিণাকুণ্ডুর ফলসি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে দিদার হোসেন নাকে একজন নিহত হন। তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক। ৭ মে চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের দিন নিহত হন ৮ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর বাগমারার আউচপাড়া ইউনিয়নে পুলিশের গুলিতে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী সিদ্দিকুর রহমান (২৪) ও মুনতাজ (৪২) নিহত হন।

নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেনের সমর্থক হোসেন আলী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন। রায়পুরার শ্রীনগর ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক আহমদ আলীর ছেলে সুমন মিয়া (৩০) নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর দেশীয় অস্ত্রের ঘায়ে প্রাণ হারান। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে দুজন ইউপি সদস্য প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষের সময় তাপসচন্দ্র দাস (৩২) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাপস চান্দলা গ্রামের কানুচন্দ্র দাসের ছেলে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর পাড়িয়া ইউনিয়নের কালডাঙ্গা মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে তিন ইউপি প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে এক যুবক নিহত হন। তার নাম মাহবুব আলম (১৮)। তিনি মাছখুড়িয়া গ্রামের আবদুল জব্বারের ছেলে। একই দিনে বালিয়াডাঙ্গীর আমজানখোড় ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আছমা বেগম নামে একজন নিহত হন। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক লেবু মিয়া (৪০) পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

৮ মে চাঁদপুরের শাহরাস্তির দক্ষিণ রায়শ্রী ইউনিয়নে জামাল হোসেন নামে এক যুবলীগ কর্মী নিহত হন। ভোটের দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে আহত হন তিনি। একই দিনে মারা যান গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট ইউনিয়নে লেবু মণ্ডল নামে কৃষি ব্যাংকের এক অফিস সহকারী। তিনি ভোটের দিন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন।

চতুর্থ ধাপে ময়মনসিংহ সদরে সদস্য পদের ‘পরাজিত এক প্রার্থীর সমর্থকদের’ হামলায় গতকাল আহত এনামুল হক (৩০) এক যুবক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বাড়ি পরানগঞ্জ ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের নির্বাচিত ইউপি সদস্য বাবুলের সমর্থক ছিলেন তিনি। চার ধাপের সহিংসতার বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলীয় প্রতীক ছাড়াও নির্দলীয় নির্বাচনের সময়ও ইউপিতে সংঘর্ষ ও মারামারি হয়। এবারও তাই হয়েছে। ইউপিতে মূলত দ্বন্দ্ব হয় সামাজিক, পারিবারিক ও দলীয় কোন্দলের কারণে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন এবারই প্রথম এ কারণে অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। যে কারণে কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে আরও কয়েকটি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলে এসব কমে আসবে।’ অন্যদিকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ নির্বাচনের সহিংসতার ঘটনাকে সামাজিক ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বলে জানান। সব ঘটনাই নির্বাচনকেন্দ্রিক নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক। কে কোন দলের তা না দেখে প্রতিটি ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। সহিংসতা দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে ভবিষ্যতে মানুষ নির্বাচনের নাম শুনলেই ভয় পাবে। কেউই ভোট কেন্দ্রে যেতে চাইবে না। আমার মনে হয়, সেদিকেই যাচ্ছে দেশ।-বিডি প্রতিদিন

১০ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে