মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:৫৪:২৪

রাজধানীর মৃত্যুফাঁদ!

রাজধানীর মৃত্যুফাঁদ!

ইউসুফ সোহেল : রাজধানীতে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। ঘর থেকে অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়ে বের হতে হয়। সুস্থ-সবল দেহে যে ব্যক্তি সকালে বের হলো ফিরছে লাশ হয়ে। সর্বশেষ উদাহরণ রোববার সকালে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় ২ বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় চাপা পড়ে আবুল কালাম নামে এক পথচারী ও কদমতলীর ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনে ট্রাকের ধাক্কায় রবিউল ইসলাম নামে এক স্কুলছাত্রের করুণ মৃত্যু।

এছাড়া গত বৃহস্পতিবার সকালে যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ মোড়ে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাতের সামনে বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় দাদি আঙ্গুরা বেগমের করুণ মৃত্যু। ওই ঘটনায় আহত হয় নুসরাতও। অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় সারা দেশের দুর্ঘটনার ২০৯টি ব্ল্যাকস্পট চিহ্নিত করা হয়।

এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ৫১ স্পট। একটি জায়গার আধা কিলোমিটারের মধ্যে একাধিকবার দুর্ঘটনার ভিত্তিতে এসব স্পট চিহ্নিত করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়তি নজরদারিসহ সার্বিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন স্পটে দুর্ঘটনার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু এসবে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা যায়, দেশে সারা বছর যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এর ৩৫ শতাংশ ঘটে জাতীয় মহাসড়কের ৪ ভাগ এলাকায়। মহাসড়কের ২০৯টি স্থানকে অতিদুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে এগুলোকে ‘ব্ল্যাকস্পট’ নাম দেওয়া হয়।

এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ৫১ স্পট। এগুলোর মধ্যে বিজয় সরণি, শনিরআখড়া, ফার্মগেট, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, সোনারগাঁও, সায়েদাবাদ, রূপসী বাংলা ক্রসিং, জিপিও মোড়, উত্তরা জসীমউদ্দীন রোড ক্রসিং, মালিবাগ মোড়, মৌচাক মোড়, বাংলামোটর ক্রসিং, কাকরাইল মোড়, শান্তিনগর মোড় ও মুগদা স্টেডিয়াম ক্রসিংকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির্পূণ স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি ঢাকার ২০০ ইন্টার সেকশনের মধ্যে ৯ শতাংই ঝুঁকিপূর্ণ।

এ ঝুঁকিপূর্ণ অংশেই রাজধানীর শতকরা ৫২ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্রিজ, হাতিরঝিল, যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ মোড়, উত্তরার আবদুল্লাহপুর মোড়, তুরাগের আশুলিয়া বাঁক, এয়ারপোর্ট গোলচত্বর, বিমানের বলাকা প্রধান কার্যালয়ের সামনের বিশ্বরোড, যাত্রাবাড়ী মোড়, কুড়িল বিশ্বরোড, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, আগারগাঁও ক্রসিং, মগবাজার মোড়, মহাখালীর মোড়, সায়েদাবাদ রেলক্রসিং, পল্টন মোড়, ফার্মগেট মোড়, কদমতলীর শ্যামপুর ওয়াসা গেটসংলগ্ন ঢাকা মেস এলাকা, মেরুল বাড্ডার এশিয়ান হাসপাতালের সামনে, কারওয়ানবাজার পান্থপথ মোড়ে, কল্যাণপুরে বিআরটিসি বাস ডিপো গেটের সামনে, ক্যান্টনমেন্ট থানার কালশী এলাকা ও মতিঝিলের শাপলা চত্বর ছাড়াও কয়েকটি স্থান রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ।

এসব স্পটে সাধারণ মানুষের ভিড় ও অতিরিক্ত পরিবহন চলাচলের কারণে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। তবে পুলিশের দুর্বল নজরদারির কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ঘাতক যানবাহন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩১১ জন নারী-পুরুষ-শিশু। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৩ জন। আহত হন ২৭৭ জনেরও বেশি মানুষ। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ৩ দিনেই সড়কে ৮ জনের প্রাণ ঝরেছে। এই কদিনে সড়কে আহত ২৩ জনেরও বেশি মানুষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
 
অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার ছাড়াও ট্রাফিক আইন মেনে না চলার প্রবণতা, প্রশাসনের উদাসীনতায় অধিকাংশ জেব্রাক্রসিং ও স্পিডব্রেকারগুলোয় চিহ্ন না থাকা, অসাবধানবশত যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার না করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পার হওয়া, ফাঁকা রাস্তা পেয়ে দ্রুতগতিতে দুই পরিবহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, চলন্ত গাড়িতে ওঠানামা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রাস্তার অপ্রশস্ততা, ফুটপাত দখল হওয়ায় রাস্তা দিয়ে চলাচল, অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া ও বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানো, ওভারলডিং, ওভারটেকিং এবং ওভারস্পিডসহ ত্রুটিপূর্ণ সড়কব্যবস্থার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণে দিন-দিন ঢাকার রাজপথ এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খন্দকার গোলাম ফারুক প্রতিবেদককে জানান, অদক্ষ চালকের বেপরোয়া যানবাহনের গতির কারণেই ঘটছে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা। তবে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার ও মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে গিয়েও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে।

এআরআইর এক জরিপে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশের বয়সসীমা ১৬-৩০ বছরের মধ্যে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ মারা গেছে ৩১-৪৫ বছর বয়সি, দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ২০ শতাংশ শিশু, যাদের বয়সসীমা ০ থেকে ১৫ বছর। ৪৬ থেকে ৬০ বছর বয়সি মানুষ মারা যায় ১৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১ বা তার বেশি বয়সি মানুষের মৃত্যুর হার ৭ শতাংশ। অসচেতনতা থেকে যুবক শ্রেণিই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত এসব ঘটনার শতকরা ৫৪ ভাগই পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা।

এ ছাড়াও গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ, পশ্চাদ্ভাগে আঘাত এবং উল্টে যাওয়াজনিত দুর্ঘটনায় প্রায় ৮৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী। মুখোমুখি সংঘর্ষে শতকরা ১৩ ভাগ, পশ্চাদ্ভাগে আঘাতে ১১ ভাগ, পার্শ্ব ঘর্ষণে ৫ ভাগ, দাঁড়ানো গাড়িকে আঘাত ও রাস্তার পাশের বস্তুতে আঘাতে ২ ভাগ, সমকোণে ১ ভাগ এবং অন্য কারণে ৪ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে এসব দুর্ঘটনায় জড়িত চালকরা পার পেয়ে যায় দুর্বল আইনের কারণে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্বল আইন, ভঙ্গুর সড়ক অবকাঠামো এবং চালকদের অদক্ষতার কারণে প্রতিবছর অপ্রতিরোধ্য হারে বেড়ে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টা। মোটরসাইকেলে স্ত্রী ও কন্যাশিশুকে নিয়ে কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন সদ্য ইতালি ফেরত সাখাওয়াত হোসেন। আপন গতিতে চলছিলেন, হঠাৎ  কমলাপুরগামী মোড়ের বাঁকে (স্টেডিয়ামের সামনে) পরিবারসমেত উল্টে পড়ল তার মোটরসাইকেল। কোনো গাড়ি অথবা সড়কদ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষ না হলেও এই দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে সাখাওয়াত বলেন, রাস্তায় যে স্পিডব্রেকারটি রয়েছে, বুঝতে পারিনি। তাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে স্পিডব্রেকারটিতে কোনো চিহ্ন ছিল না। ঘটনার সময় পেছন দিক থেকে কোনো যানবাহন না আসায় পরিবারটি এ যাত্রায় রক্ষা পায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এভাবে সড়কে স্পিডব্রেকারে নেই কোনো জেব্রাচিহ্ন। জেব্রাচিহ্ন মুছে গেলেও প্রশাসনের উদাসীনতায় এসব স্পিডব্রেকার থাকে সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এসব এলাকায় অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত দখলের কারণে পথচারীদের বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। এর ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটলেও অসতর্ক চালকদের বিরুদ্ধে মামলা হয় যৎসামান্য। পরে টাকার বিনিময়ে আপসরফা হয়। এ কারণে চালকরা রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন স্পটগুলোর মধ্যে হাতিরঝিল একটি। এখানে বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। দুর্বল নজরদারির কারণে এখানে চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। গত ১৩ আগস্ট একটি মাইক্রোবাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রী এক বছর ও ১১ মাসের ২ শিশুসহ একই পরিবারের ৪ জন আহত হন। ১৮ জুলাই হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ি সড়কে ঈদ উদ্যাপন করতে গিয়ে পিকআপভ্যান উল্টে সুমন নামে এক কিশোর নিহত এবং আরও ৭ জন আহত হয়।-আমাদেরসময়
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে