বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬, ০৫:৫৯:১৫

মনোনয়ন–বাণিজ্য থেকে গৃহবিবাদ

মনোনয়ন–বাণিজ্য থেকে গৃহবিবাদ

নিউজ ডেস্ক: ‘মনোনয়ন-বাণিজ্য’ নিয়ে বিএনপিতে গৃহবিবাদ আরও বাড়ছে। এর রেশ দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। নেতারা বলছেন, দলে এখনকার বিবাদ মূলত কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে। এটা কম-বেশি সব দলেই হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।


বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলেছে, গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন এবং দলীয় প্রধানের কাছে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা মনোনয়ন-বাণিজ্য নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে উল্লেখ করে এর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।


সম্প্রতি দলের সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলামের ব্যবসায়িক ব্যাংক হিসাবে গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার লেনদেন নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিষয়টি সামনে আসে। দলেও এ নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে বিষয়টি তোলেন এক নেতা।


তাইফুল ইসলাম বলেছিলেন, তাঁর ব্যাংক হিসাবের এক বছরের লেনদেন প্রকাশ করা ছিল ষড়যন্ত্র। কারণ, তাঁর আগের দুই বছরেও সমপরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে। সে সময় তিনি সহদপ্তর সম্পাদক পদে ছিলেন না, কোনো নির্বাচনও ছিল না। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ অনেক জায়গাতেই আছে। তবে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও স্থানীয় পর্যায়ে টাকার বিনিময়ে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেক সময় এক পক্ষ নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর মনোনয়ন না পেলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ আনছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন সমন্বয়ের সঙ্গে যুক্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ বলেন, ‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের খবর পত্রপত্রিকায় দেখি। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো পর্যায়ে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে বলে জানি না।’
আর দলের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সমন্বয়কারী মো. শাহজাহান বলেন, যে নির্বাচন (ইউপি) সকাল ১০টায় শেষ হয়ে যায়, সে নির্বাচনে টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনে প্রার্থী হতে যাবে কোন দুঃখে? নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী বিগত চার ধাপের মোট ৩৫৬টি ইউপিতে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন না। এর ১৫৪টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। ৩৫৬টিতে অনেকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি, কেউ ভয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেননি। এমন অবস্থায়ও দলের প্রার্থী মনোনয়নে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।


যদিও নেতাদের একটি অংশ বলছে, বিএনপি এখন যে পরিস্থিতিতে আছে, তাতে টাকা দিয়ে মনোনয়ন নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, প্রায় ১০ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। প্রায় সবার বিরুদ্ধে মামলা আছে। অনেক জায়গায় বিএনপি প্রার্থীও খুঁজে পাচ্ছে না। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী শহীদ অভিযোগ করেন, তাঁদের উপজেলার পাঁচটি ইউপিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে টাকার বিনিময়ে। জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান তৃণমূলের মতামত না নিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। এ জন্য গত শনিবার আহমদ আজমকে বাসাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় বলে তিনি দাবি করেন।


জানতে চাইলে আহমেদ আজম খান বলেন, গত শনিবার তিনি বাসাইলে গিয়েছেন। পাঁচজন প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা করেছেন। গত মঙ্গলবার স্থানীয় বিএনপি শহীদের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে। পাঁচজন প্রার্থীই সমাবেশে বলেছেন, তাঁরা এক টাকাও মনোনয়নের জন্য কাউকে দেননি। আহমদ আজম বলেন, ‘আমার মতো মানুষ যদি কমিটি বা মনোনয়ন-বাণিজ্য করে, তাহলে আর কিছু থাকল না।’ গত সোমবার মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফখরুদ্দীন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।


দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, ওই দিনের বৈঠকে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ সামনে এনে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হলেও এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কার্যত এই প্রতিক্রিয়া কমিটি গঠন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতাসহ দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে ক্ষোভের একটি বহিঃপ্রকাশ।
দলীয় সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বহুমাত্রিক। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দলের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন উত্তর কমিটি গঠনে নিজেদের অসম্পৃক্ততা। কারণ, নতুন কমিটি গঠনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের সম্পৃক্ত না করে মাঝারি পর্যায়ের কয়েকজন নেতার পরামর্শ নিচ্ছেন বলে দলের ভেতরে-বাইরে জোর আলোচনা আছে। ফলে ঘোষিত কমিটি জ্যেষ্ঠ অনেক নেতার মনমতো হচ্ছে না। পাশাপাশি ১৯ মার্চ সম্মেলনের পর প্রায় দুই মাস হতে চললেও স্থায়ী কমিটি ঘোষণা না করায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে অস্বস্তিতে আছেন। তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দীর্ঘসূত্রতায় বিরক্ত।


এ ছাড়া দলের সম্ভাব্য স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে আলোচনায় থাকা কাউকে কাউকে ঠেকিয়ে সেখানে পছন্দের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করানোর কৌশল থেকেও ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদের বৈঠকে আনা হয়েছে এমন দাবি করছেন নেতাদের কেউ কেউ।


স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে একজন প্রবীণ সদস্য বলেছিলেন, কমিটি করার ক্ষেত্রে তাঁর জানামতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কারও মত বা পরামর্শ খালেদা জিয়া নিচ্ছেন না। এতে কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই হতাশ।


বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, সম্মেলনের প্রায় দুই মাসেও দলের জাতীয় নির্বাহী ও স্থায়ী কমিটি না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। একই সঙ্গে পদ-পদবি পাওয়া নিয়ে নেতাদের মধ্যে চেষ্টা-তদবিরের পাশাপাশি কোন্দলও বাড়ছে। নতুন কমিটিতে অবস্থান ধরে রাখতে সক্রিয় দলের পরস্পর বিবদমান পক্ষগুলো। এর জন্য মওকামতো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করারও চেষ্টা চলছে। আংশিক কমিটি ঘোষণার পর কিছু ক্ষেত্রে তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কমিটিতে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা জায়গা পাওয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছেন তাঁরা। এই অবস্থায় কেউ কেউ যোগাযোগ শুরু করেছেন লন্ডনে তারেক রহমান এবং মালয়েশিয়ায় তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে। নেতারা বলছেন, কমিটি ঘোষণা করতে এত সময় না নিলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।-প্রথম আলো

১১ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে