বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬, ০৯:১৭:২৩

বাংলাদেশি গৃহকর্মী সেই সুফিয়ার স্মরণে স্কুল বানালো আমিরাত

বাংলাদেশি গৃহকর্মী সেই সুফিয়ার স্মরণে স্কুল বানালো আমিরাত

জাকারিয়া পলাশ : সুফিয়া আক্তার ওরফে জোসনা। ছয় সন্তানের জননী। পরিবারে অসুস্থ, কর্মহীন স্বামী। তাই পরিবারের দায়িত্ব পড়ে সংগ্রামী সুফিয়ার কাঁধে। জীবিকার সন্ধানে পাঁচ বছর আগে পাড়ি জমিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাত। তার আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়ে রোজীনাকেও ফেলে রেখে গিয়েছিলেন গ্রামে। দুবাইতে সুফিয়া কাজ করতেন গৃহপরিচারিকার। আমিরাতের ভাষায় গৃহপরিচারিকাকে বলা হয় ‘নানী’।

দুবাইয়ের দুইটি শিশুর তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত এই বাঙালি নানী জীবন দিয়েছিলেন ওই শিশুদের বাঁচাতে। ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর। তার সেই আত্মত্যাগ নাড়া দিয়েছিল গোটা আরব আমিরাতকে। সাতটি আরব রাজ্যের সমন্বিত রাজতান্ত্রিক দেশটির খোদ প্রধানমন্ত্রী কাম ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রসিদ আল মাকতুম আমলে নিয়েছিলেন বিষয়টি।

তিনি দুবাই শহরের শাসকও। তারই নির্দেশনায় দুবাই কেয়ার নামে একটি সংস্থা এগিয়ে এসেছে সুফিয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে। তার নামে স্থাপিত হয়েছে একটি স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর। সুফিয়ার নিজ গ্রাম ভাটাপাড়ায়, সুনামগঞ্জের হাওড়ের পাড়ে শুরু হতে যাচ্ছে ভাটাপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলটি শিক্ষার আলো ছড়াবে অন্তত ৩২০০ শিশুর মধ্যে। পূর্ণ করবে একটি বিরাট শূন্যতা। স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিমধ্যে ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরষ ইউনিয়নের ওই গ্রামটিতে এক একর জমি কেনা হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ  টাকায়।

গত মঙ্গলবার এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঢাকাস্থ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি এবং ঢাকায় স্থাপিত ইউএই’র ভিসা সেন্টারের পরিচালক আবদাল্লাহ আল শামস উপস্থিত ছিলেন হাওড়ের সেই গ্রামে। উপস্থিত ছিলেন, দুবাইভিত্তিক সংস্থা দুবাই কেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক আল গার্গ, স্থানীয় জন প্রতিনিধিরাসহ ব্র্যাক ও দুবাই কেয়ারের কর্মকর্তাবৃন্দ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তারিক আল গার্গ বলেন, এই স্কুলের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা সুফিয়ার সাহসিকতার স্মরণ করছি। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই গ্রামে যাতে আরও অনেক সুফিয়া জন্ম নিতে পারে, যারা মানুষের সেবায় জীবন দিতে পারবে তার আশা করছি। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসেই স্কুলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শুরু হবে পাঠদান কার্যক্রম।

স্থানীয়ভাবে স্কুলটির নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার কাজ করবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। দুবাইভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠান স্কুলটি নির্মাণের পর পরিচালনার জন্য ছয় বছর অর্থায়ন করবে।

ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে এলাকাটি কাঁচা রাস্তায় যান চলাচলের অনুপযোগী। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে অতিথিরা গিয়েছিলেন মোটরবোটে করে। স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গ্রামের প্রায় সব মানুষ। শিশুদের সংখ্যা তার মধ্যে বেশি। অধিকাংশই তাদের মধ্যে স্কুল ছাড়া। কিংবা, দূরে বলে স্কুলে যায় অনিয়মিত।

সাহানা নামের এক কিশোরীর মন্তব্য, আমি আনন্দিত যে আমাকে স্কুলে যেতে এখন আর আড়াই কিলোমিটার কাঁদা মাড়াতে হবে না। আমার মতো গ্রামের সব শিশুই নিশ্চয়ই আনন্দিত। কারণ, এখানে এখন স্কুল হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী বাদশাহগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার বজলুর রহমান বলেন, এখানে একটি স্কুল খুবই প্রয়োজন ছিল। এখন এখানে শিক্ষার বিকাশ হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

সেলবরষ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমেদ বলেন, আশেপাশের প্রত্যেক গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু, এই ভাটাপাড়ায় ছিল না। কাগজে-কলমে সরকারের খাতায় এই এলাকা ছিল স্কুলশূন্য। এবার সেই শূন্যতা পূরণ হলো। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের এখন এই স্কুলের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়া উচিত।

যেভাবে জীবন দিয়েছিলেন সুফিয়া: ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর সুফিয়া তার বাড়িওয়ালার পরিবারের সঙ্গে যান সমুদ্রের উপকূলে বেড়াতে। সেখানে ওই পরিবারের ছয় ও দশ বছর বয়সী দুইটি শিশু সমুদ্রে পড়ে গেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্ধার করেন সুফিয়া। তীব্র স্রোতের মোকাবিলা করে প্রথম একটি শিশুকে রক্ষা করেন। তাকে কিনারে এনে রেখে দিয়ে তিনি ফের ঝাঁপ দেন দ্বিতীয় শিশুটির সন্ধানে। তাকেও ফিরিয়ে আনেন।

কিন্তু, পরক্ষণেই তিনি সমুদ্রের তীরে জ্ঞান হারান। এবং ভাটির টানে সমুদ্রের মাঝে হারিয়ে যান। হারিয়ে যাওয়া সুফিয়া আমিরাতি শিশু দুটির জীবন বাঁচাতে যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন তা আজ ফিরিয়ে এনেছে তাকে তার নিজ গ্রামে অন্যভাবে। তার আত্মত্যাগের এই খবর প্রকাশিত হয় আমিরাতের অধিকাংশ গণমাধ্যমে। এর ফলে তা দৃষ্টিকাড়ে প্রধানমন্ত্রীর।

তিনি তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন দুবাই কেয়ারকে নির্দেশনা দেন সুফিয়ার নিজ গ্রামে তার স্মরণে কিছু করার জন্য। দুবাই কেয়ার হলো বিনামূল্যে শিক্ষা সেবাদানকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন। তারা বাংলাদেশে অবস্থিত ইউ.এ.ই দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুবাই কেয়ারের সিইও তারিক আল গার্গ এ বিষয়ে  বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা অবগত যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে অনেক বিলম্ব হয়।

সরকার প্রায় এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর আমাদের প্রস্তাব দিয়েছিল, সুফিয়ার নামে একটি ফান্ড দিয়ে দিতে। তা থেকে সরকার কিছু শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করবে। কিন্তু, আমরা চেয়েছিলাম বাস্তবিকভাবে সুফিয়ার গ্রামে কিছু একটা করতে। পরে আমরা ব্র্যাককে আমাদের সক্রিয় সহযোগী হিসাবে পেয়েছি। সুনামগঞ্জের ব্র্যাক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, ব্র্যাকের তত্ত্বাবধানে সুনামগঞ্জে মোট সাতটি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। ভাটাপাড়া গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন ছিল।

ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি প্রথমিক বিদ্যালয় ছাড়া গ্রামে আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। হাওড়ের কাঁচা রাস্তা, বর্ষাকালে অনেক কষ্ট করে তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে দূরের স্কুলে যায় ছেলে মেয়েরা। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি।

সুফিয়ার ছয় সন্তানের মধ্যে দুইজনই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। তার বড় মেয়ে লুবা (১৯) পড়েছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। সে এখনই দুই সন্তানের মা। দ্বিতীয় মেয়ে সুবার বয়স ১৫। সেও লেখাপড়া ছেড়েছে বেশ আগেই। তাকে এই বয়সেই বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন বাবা খোরশেদ। তৃতীয় মেয়ে রুনা (১৩) পড়ে ৭ম শ্রেণিতে। বড় ছেলে মাজহার পড়ে মাদরাসায়। আরেক ছেলে শাকেরুল (৯) তৃতীয় এবং সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে রোজীনা (৮) দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাদের মধ্যে কেউই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতো না। শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া এমন অবহেলিত গ্রামে সুফিয়ার সৌজন্যে পৌঁছেছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে সুফিয়ার বড় মেয়ে লুবা বলেন, আমার মা এই গ্রামে চিরস্মরণীয় হয়ে গেলেন। এজন্য আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু, আমাদের ভেঙে পড়া মাটির ঘর আর জীবনযাপনের অনিশ্চয়তার কোনো সমাধান হয়নি। আমরা তা নিয়ে চিন্তিত।

দুবাই কেয়ারের সিইও তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছি। অবিলম্বে অন্যান্য সংস্থা যারা মানবিক সাহায্য দিতে সক্ষম তাদের আমরা তোমাদের জন্য কিছু করার অনুরোধ করবো। -এমজমিন
১২ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে