বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬, ০৮:৪৩:৪১

খালেদা জিয়ার জেলজীবন আসন্ন!

খালেদা জিয়ার জেলজীবন আসন্ন!

পীর হাবিবুর রহমান : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জেলজীবন আসন্ন। আদালত পাড়া থেকে রাজীনীতির অন্দর মহলে এমন গুঞ্জন শুরু হয়েছে।  সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি’র নেতৃত্ব এবং পর্যবেক্ষকরাও এমনটি আশঙ্কা করছেন। বেগম খালেদা জিয়া জেলে গেলে দলের হাল কে ধরবেন- এ নিয়ে বিনএনপি’র অভ্যন্তরে চলছে চিন্তা-ভাবনা।

বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে।  এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, গেটকো দুর্নীতি মামলা, বড় পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা, ও নাইকো দুর্নীতি মামলা অন্যতম, যা দুর্নীতি দমন কমিশন করেছে।  এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

এ মামলায় বকশীবাজারের বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেয়ার কথা। কিন্তু মামলাটি স্থগিত চেয়ে খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানি শেষ হয়েছে।  

এ বিষয়ে হাইকোর্ট আদেশের জন্য ১৫ মে দিনটি ধার্য করেছেন।  এ দিন হাইকোর্ট যদি তার আবেদন খারিজ করে দেন তাহলে তাকে বকশীবাজার বিশেষ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে যেতে হবে।  আত্মপক্ষ সমর্থন শেষে দু’পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য করবেন।

আইনজীবীদের ধারণা, এই মামলায় তাকে জেল ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।  দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগও হারাবেন।  

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মাধ্যমে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালে ৮ আগষ্ট তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করে দুদক।  ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।  

সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার সামনে জেলজীবন আসন্ন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।  লন্ডন নির্বাসিত পুত্র ও বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপরও ঝুলছে মামলার খড়গ।  এরই মধ্যে তার নামে জারি হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের করা বহুল আলোচিত ৫টি মামলার বাইরে ১৪টি মামলা রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করা সহিংশতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির পিটিশন মামলা।

গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদার আপিল

গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দায়ের করা রিট হাইকোর্টে খারিজ হয়েছিল।  হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছেন মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তেঁজগাও থানায় গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী।

মামলা হওয়ার পরদিন খালেদা জিয়া ও কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়।  ১৮ সেপ্টেম্বর মামলাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় জরুরি ক্ষমতা আইনে। পরের বছর ১৩ মে খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

মামলাটি জরুরি ক্ষমতা আইনের অন্তর্ভুক্ত করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন খালেদা জিয়া।

এর তিনদিন পর খালেদা ও কোকোর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল দেয় হাইকোর্ট। মামলাটি জরুরি ক্ষমতা আইনের অন্তর্ভুক্ত করা কেন ‘বেআইনি ও কর্তৃত্ব বহির্ভূত’ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।  তবে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ পরে আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়।

দুদক আইনে গ্যাটকো মামলা দায়েরের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৮ সালে আরেকটি রিট আবেদন করেন খালেদা জিয়া। তার আবেদনে হাইকোর্ট আবারও মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়।

দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর দুদক মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল রুলের শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে ১৭ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে আদালত। একই বছর ৫ আগস্ট হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার রিট খারিজ করে দেন। চলতি বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।

বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম শামসুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামীও এ মামলার আসামি।  অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলাটি বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান।

এ মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ জানান, হাইকোর্টে এ মামলার ব্যাপারে করা রিট খারিজ হয়ে গেলে লিভ টু আপিল দাখিল করা হয়েছে। এখন মামলাটি আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে।  বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। আইনজীবী জানান, হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শেষ হয়েছে। আদেশ হয়নি।এখনো বিচার শুরু হয়নি।

নাইকো দুর্নীতি

নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলা করে দুদক। জজকোর্টে এ মামলার অভিযোগপত্র গঠনের শুনানি চলছে।

অন্যান্য মামলা

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সহিংস ও নাশকতার অভিযোগে ঢাকাসহ দেশের থানায় বিভিন্ন মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান ও কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থানায় ২টি, খুলনা সদর থানায় একটি এবং রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানায় তিনটি মামলা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে গুলশান, কুমিল্লা ও খুলনার মামলাগুলো তদন্তাধীন। তবে যাত্রাবাড়ি থানার মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে চারটি পিটিশন মামলা রয়েছে। এ মামলাগুলোও তদন্তাধীন বলে জানা গেছে।

তারেক রহমান

তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানও স্বামীর সঙ্গে দুদকের একটি মামলার আসামি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মৃত আরাফাত রহমান কোকোও সাতটি মামলার আসামি ছিলেন।

বিদেশে অর্থ পাচার মামলা

তারেক রহমানের অর্থ পাচারের মামলায় দুদকের করা আপিল শুনানি হাইকোর্টে চলছে।

রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারেক রহমানের নামে একটি মামলা করে দুদক। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা নেন। সিঙ্গাপুরে এ টাকা লেনদেন হয়।

এরপর মামুন ওই অর্থ সিঙ্গাপুরের ক্যাপিটাল স্ট্রিটের সিটি ব্যাংক এনএতে তার নামের ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এ টাকার মধ্যে তারেক রহমান তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

এ মামলায় তারেক রহমানকে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর বেকসুর খালাস দেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত। আর তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে অর্থপাচার মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। রায়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি মামুনকে ৪০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। পাচার করা ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৬১৩ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দেন আদালত।

এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি এ আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে তারেক রহমানকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন হাইকোর্ট।

সেই আত্মসমর্পণের সমন তারেকের লন্ডনের সাবেক ও বর্তমান ঠিকানায় পাঠাতে সিএমএম কোর্টকে কয়েকবার সময় দেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও তার সব ঠিকানায় সমন পাঠানো হলেও তিনি আত্মসমর্পণ করেননি বলে হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে।

সর্বশেষ ৩১ মার্চ তারেকের সমন লন্ডনের নতুন ঠিকানায় পৌঁছেছে কি না তা সিএমএম আদালতের কাছে জানতে চেয়ে ৬ এপ্রিল আদেশের দিন ধার্য করেছিলেন হাইকোর্ট। লন্ডন হাইকমিশনের মাধ্যমে তারেকের ঠিকানায় সমন পৌঁছার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য নতুন এ দিন ধার্য করেন।

লেখক, প্রধান সম্পাদক: পূর্বপশ্চিমবিডি.কম
১২ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে