নিউজ ডেস্ক : অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ওপরই দলের নির্বাহী কমিটিতে পদ-পদবি প্রদান ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানে বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ায় চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী এবং নানা দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিতর্কিত নেতাদের সরাসরি দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় আসা পদ-পদবি এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের ঘটনা তদন্তেরও দাবি তোলেন বর্ষীয়ান এসব নেতা। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের একের পর এক প্রশ্নবাণে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থাও সৃষ্টি হয় বৈঠকে। প্রকাশ্যে কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা না দিলেও পরে খোঁজখবর নিয়ে চেয়ারপারসনকে জানানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে গুলশান কার্যালয়ের এক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে। আর এতেই বেধেছে যত গণ্ডগোল।
‘যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, যিনি হলেন সব অপকর্মের হোতা— তাকেই ঘটনার খোঁজখবরের দায়িত্ব দিলেন চেয়ারপারসন?’ এ প্রশ্ন এখন দলীয় নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে। এর ফলে দলের নাম ভাঙিয়ে করা দুর্নীতি-অনিয়ম নানা অপকর্মের বিচার শেষ পর্যন্ত যে কী হবে, তা সহজেই অনুমেয় বলে উল্লেখ করেন স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য।
সাবেক একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, আমি সহসাই আশাপ্রদ কিছু দেখছি না। তবে ‘ম্যাডামের’ উচিত দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী ব্যক্তিদের সরাসরি দল এবং তার কার্যালয় থেকে বের করে দেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। ‘ম্যাডাম’ যদি এই মুহূর্তে এটুকু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, তবে দলের ভাবমূর্তি আরও বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার (ম্যাডামের), দলের এবং আমাদের সবার কপালেই ‘খারাবি’ আছে অদূর-ভবিষ্যতে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আমরা তার কাছে এ দাবি জানিয়েছি জোরালোভাবে। তবে আশা করছি যে, এবার অন্তত ম্যাডাম এসব ‘ভ্রষ্টাচার’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। কারণ ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি’ জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলের ভাবমূর্তি কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে এভাবে ভূলুণ্ঠিত হোক— তা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.) বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে তাদের বিষয়ে তদন্তের মাধ্যমে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় দলের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার দূরের কথা— সংশ্লিষ্ট অসৎ প্রকৃতির ব্যক্তিরা তাদের অপকর্ম মহাসমারোহে অব্যাহত রাখবে।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, সততার প্রতীক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে অবশ্যই দুর্নীতি-অপকর্মসহ দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। বিতর্কিত এই ব্যক্তিদের তাত্ক্ষণিকভাবে দল থেকে বিদায় করে দিতে হবে।
জানা গেছে, প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও দলের প্রায় সব সিনিয়র নেতাই এখন চরম ক্ষুব্ধ। তারা মনে করেন, দলের ইমেজ নষ্টকারী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বার বার এ ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজি ও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলেও সেসব অভিযোগকে দলের বিরুদ্ধে সরকারের ষড়যন্ত্র কিংবা মিডিয়ার বাড়াবাড়ি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে থেকে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখেন। এবারও হয়েছে তা-ই। যাদের নামে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তাদেরই পরোক্ষভাবে দলের হাইকমান্ড এসব ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে বলে জানা যায়।
বিতর্কিত এক ব্যক্তিকেই শেষ পর্যন্ত খোঁজখবর নিয়ে চেয়ারপারসনকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ভিতরে ভিতরে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। জানা যায়, পত্র-পত্রিকাসহ সব মিডিয়ায় দলের পদ-পদবি ও মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন নেতা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই প্রকাশিত এসব সংবাদের কাটিং নিয়ে আগেভাগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে দলের বিরুদ্ধে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ষড়যন্ত্র ও মিডিয়ার বাড়াবাড়ি বলে অভিহিত করেন।
একই সঙ্গে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ‘কাতর আবেদন’ জানান। তাদের এই কান্নাজড়িত কাতর আবেদনের অভিনয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন নিজেও অনেকটা আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং গুলশান কার্যালয়ের সবচেয়ে ‘ক্ষমতাধর ও বিতর্কিত’ ব্যক্তিদেরই পরোক্ষভাবে এসব ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেন বলে জানা যায়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ দুই ঘণ্টার আলোচনা জুড়ে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন ও দলের কমিটি গঠনে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগসহ কার্যালয়ের কর্মচারীদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায়।
বিএনপির ইমেজ সংকটের প্রশ্ন তুলে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনসহ জড়িত ব্যক্তিদের দল ও কার্যালয় থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে স্থায়ী কমিটির দুজন নেতা এসব অভিযোগকে সরকারের অপপ্রচারের অংশ বলে মন্তব্য করে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের পক্ষে সাফাই গান। তারা বলেন, দল এখন একটি সংকটকাল পার করছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে সে সংকটকে আরও জটিল করে তুলতে চাইছে সরকার। এ নিয়ে নেতারা পক্ষে-বিপক্ষে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। -বিডি প্রতিদিন
১৩ মে ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস