শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬, ১২:৫৮:৪২

চাপের মুখে বিএনপির কূটনৈতিক উইং

চাপের মুখে বিএনপির কূটনৈতিক উইং

কাফি কামাল: আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে কূটনীতিক যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতার মুখে বিএনপি। মামলা-হামলায় একের পর এক টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন দলটির কূটনৈতিক যোগাযোগে দক্ষ নেতারা। বাড়ছে নানামুখী চাপ ও ঝুঁকি। বাদ পড়ছেন না কূটনৈতিক মহলের শুভাকাঙক্ষীরাও। ইতিমধ্যে চাপ সহ্য করতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন প্রভাবশালী এক নেতা। ঝুঁকি নিয়ে দুয়েকজন সক্রিয় থাকলেও বেশিরভাগ নেতাই হয়ে পড়েছেন নিষ্ক্রিয়।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, বিএনপির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করতে নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে সরকার। এজন্য দলের কূটনৈতিক উইংয়ে দায়িত্ব পালনকারী নেতাদের একের পর এক টার্গেট করা হচ্ছে। কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সৌজন্য বৈঠক এবং আলোচনার মধ্যে খোঁজা হচ্ছে ষড়যন্ত্র। কারও ওপর হামলা করে আবার কাউকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হয়রানি করা হচ্ছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বিএনপি নেতারা সাহসের সঙ্গে এ অঙ্গনে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।


ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর বিএনপির অভ্যন্তরে ঘটেছে নানা পরিবর্তন। দলটির পক্ষে আন্তর্জাতিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন কয়েকজন সাবেক আমলা। দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর তারা গুরুত্বপূর্ণ পদও পান। সামপ্রতিক বছরগুলোতে তাদের তিনজন বিএনপির কূটনীতিক সম্পর্ক রক্ষা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে তিনজন হলেন- সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বীর বিক্রম, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহউদ্দিন আহমেদ। দলীয় মহলে তাদের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের বৈঠকে অংশগ্রহণসহ আন্তর্জাতিক যোগাযোগে তারাই ছিলেন তৎপর।

৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালের প্রথমদিন থেকেই আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে বিএনপি। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় সে আন্দোলন চলে টানা তিন মাস। তখন থেকেই মামলা-হামলায় একের পর এক টার্গেটে পরিণত হন বিএনপির কূটনীতিক যোগাযোগ রক্ষাকারী নেতা ও শুভাকাঙক্ষীরা। ২০১৫ সালের ৯ই জানুয়ারি বনানীর বাসভবনে থেকে শমসের মবিন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পরে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ছবি বিশ্বাসের ওপর হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আসামি করা হয় আন্দোলনের সময় সংঘটিত নৈরাজ্যের ঘটনায় দায়েরকৃত আরো কয়েকটি মামলায়। 

১১ই জানুয়ারি গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন সাবিহ উদ্দিন আহমেদ। ওই সময় কার্যালয়ের দক্ষিণ দিকের রাখা তার প্রাইভেট কারে আগুন দেয় একদল দুর্বৃত্ত। ঠিক তিনদিন পরের ঘটনা। ১৪ই জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ শেষে বাসায় ফিরছিলেন রিয়াজ রহমান। গুলশান-২ নম্বরের ওয়েস্টিন হোটেলে পেছনের গলিতে পার্কিং করা গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে তার ওপর হামলা করে ছয় যুবক। তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুরুতর আহত হন রিয়াজ রহমান। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এদিকে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন সাবিহ উদ্দিন আহমেদ। সমপ্রতি বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ অংশ নিলেও কার্যত অনেকটাই নিষ্ক্রিয় এই দুজন। ওদিকে গ্রেপ্তারের পর পাঁচ মাস কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পান শমসের মবিন। মুক্তির পর তিনি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে যাতায়াতই বন্ধ করে দেন। এদিকে টানা ৯২ দিনের আন্দোলনের সমাপ্তি টেনে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিয়ে বাসায় ফিরেন। তারপর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান তিনি। খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে রাজনীতি থেকে অবসরের নাটকীয় ঘোষণা দেন শমসের মবিন। তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যায়, নানামুখী চাপের কারণে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন।


তিন জনের নিষ্ক্রিয়তায় একপর্যায়ে দলটির কূটনীতিক উইংয়ের হাল ধরেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকসহ কয়েকজন। ঢাকার কূটনৈতিক জোনে ইতালীয় নাগরিক হত্যার প্রেক্ষাপটে কয়েকটি দেশের দূতাবাসের সতর্কতা জারির পর প্রেস ক্লাবের একটি আলোচনা সভায় আবদুল মঈন খান বলেছিলেন, ‘সামপ্রদায়িক জুজুর ভয় দেখিয়ে সরকার নিজেই এখন তার শিকারে পরিণত হয়েছে।’ এরপর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এমন প্রতিক্রিয়ার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন মঈন খান। বেশ কিছুদিন দলীয় বৈঠক থেকে শুরু করে সাধারণ আলোচনা সভায়ও অনুপস্থিত থাকেন তিনি।

তবে নানা চাপ এবং ঝুঁকির মুখেও ফের বিএনপির কূটনীতিতে নেতৃত্বে দিচ্ছেন ড. আবদুল মঈন খানসহ কয়েকজন সিনিয়র ও মাঝারি সারির নেতা। এদিকে সামপ্রতিক বছরগুলোতে দলীয় নেতাদের বাইরে বিএনপির পক্ষে কূটনৈতিক মহলে কাজ করতো চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক একটি উপদেষ্টা কমিটি। সে কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান। বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে গঠিত আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। সরাসরি দলের পদে না থাকলেও কূটনীতিতে বিএনপি চেয়ারপারসনকে দীর্ঘদিন থেকে সহায়তা করতেন শফিক রেহমান।

গত ১৬ই এপ্রিল শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক দফা রিমান্ডের পর বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন আরেক সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী। সেই সঙ্গে জাস্টনিউজ নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিচালনা করতেন তিনি। ২০১৫ সালের ১লা মার্চ জাস্টনিউজ বন্ধ করে দেয়া হলে কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাইরে চলে যান মুশফিকুল ফজল আনসারী। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৪ঠা মে। হঠাৎ করেই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরুর কথা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা।

তদন্ত সংস্থার সিনিয়র সমন্বয়ক সানাউল হক জানান, ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন ১১ জনের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছেন তারা। যাদের মধ্যে ওসমান ফারুকের নামও রয়েছে। যদিও বিএনপির তরফে এ তদন্তকে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া দলের যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে সরকার উৎখাতে মোসাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠকের অভিযোগ।-এমজমিন

১৪ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে