শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬, ০১:৩০:০১

মোসাদ ঝড়ে বিএনপি, সমলোচনার ঝড়

মোসাদ ঝড়ে বিএনপি, সমলোচনার ঝড়

মাহমুদ আজহার: সদ্য দায়িত্ব পাওয়া দলের যুগ্ম মহাসচিব লায়ন আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক এজেন্টের সঙ্গে বৈঠকের খবরে বিএনপির ভিতরে-বাইরে সমালোচনার ঝড় বইছে। চাঞ্চল্যকর এ তথ্যে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলেও তোলপাড় শুরু হয়েছে। দিল্লি ও আগ্রার তাজমহল  এলাকায় ইসরায়েলের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির প্রধান মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে আসলাম চৌধুরীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা-সাক্ষাতের বেশ কিছু ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবি প্রকাশের বিষয়টি অস্বীকারও করেননি আসলাম চৌধুরী। দেখা-সাক্ষাতের পাশাপাশি আগ্রার তাজমহল এলাকায় ঘুরেও বেড়ান তারা। ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফাদির ফেসবুক পেজে দেখা যায়,

সাম্প্রতিক সময়ে তোলা বেশ কিছু ছবি মেন্দি এন সাফাদি নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টে আপলোড করেন। একটি ছবিতে আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে খোশমেজাজে দেখা গেছে মেন্দি এন সাফাদিকে। এক অনুষ্ঠানে তারা দুজন ফুলের মালা গ্রহণ করেন। আরেক ছবিতে মেন্দি এন সাফাদি ও এক নারীকে ফুলের মালা পরা অবস্থায় দেখা গেছে। সেখানে তাদের পাশে হাসিমুখে আসলাম চৌধুরী অবস্থান করছেন। কে ওই নারী, তার পরিচয় জানা যায়নি।

এ ছাড়া আগ্রার তাজমহল এলাকায় তাদের একসঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি ছবি দেখা যায়। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ছবি তোলার বিষয়টি স্বীকার করেন আসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি ৫ মার্চ ব্যবসায়িক কাজে ভারতে যাই। ৯ মার্চ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করি। আগ্রার মেয়র আমাকে সংবর্ধনা জানান। তখন মেন্দি এন সাফারিকেও সংবর্ধনা জানানো হয়। কিন্তু মেন্দি যে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির নেতা, তা আমি জানতাম না। আমি মূলত পানি নিয়ে এক ব্যবসায়িক কাজে ছিলাম। সেখানে এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়।’ গণমাধ্যমে ছবি আসায় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ছবি কীভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলো তা বুঝতে পারছি না। আমাকে ট্রেপে ফেলে এটা করা হয়েছে কিনা তাও জানি না। তবে এ ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা নেই আমার।’

এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি ইসরায়েলের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ‘জেরুজালেম অনলাইন ডট কম’-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রকাশিত হয়। সেখানে মেন্দি এন সাফাদি বলেছেন, ‘শিগগিরই সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দরজা ইসরায়েলিদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। আর এটা অসম্ভব কোনো আকাঙ্ক্ষা নয়। নির্যাতিত এবং মানুষের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা একটি নৈতিক দায়িত্ব। সেজন্য আমি এসব লোকের সহায়তার জন্য রয়েছি। বাংলাদেশে নির্যাতিক কাহিনীগুলো সত্যিকারের। প্যালেস্টাইনের মতো বানানো নয়। এখানে মানুষ নিপীড়িত হচ্ছে, কারণ তারা ভিন্নমতের। এক্ষেত্রে আমি ইসরায়েলি হিসেবে গর্বিত। আমি আরও গর্বিত যে, অনেক বাংলাদেশি ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও বাংলাদেশের নাগরিকদের পাসপোর্টেও লেখা থাকে, ইসরায়েল ছাড়া সারা বিশ্বে তারা ভ্রমণ করতে পারবে।  সেটাও আমি শিগগিরই পরিবর্তন করতে যাচ্ছি।’ 

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলের ভিতরে-বাইরে চাপের মুখে এ ইস্যুতে আসলাম চৌধুরীকে তলব করে বিষয়টির সত্যতা জানতে চান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ সময় আসলাম চৌধুরী নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। ইসরায়েলি নেতার সঙ্গে তার ছবি প্রকাশে মনঃক্ষুণ্ন হন বিএনপিপ্রধান। তাকে সতর্কভাবে চলতেও বলা হয়েছে। লন্ডনে অবস্থান নেওয়া দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা দাবি করেছেন। এ নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও অধিকাংশ সদস্যই বিস্ময় প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। অবশ্য মোসাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই,

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দলের এমন অবস্থান তুলে ধরেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, বিএনপি এমনিতেই নানামুখী চাপে রয়েছে। এর মধ্যে এ ধরনের খবর দলকে আরও বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে। এটা বিএনপির জন্য খুবই বিব্রতকর। কারণ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো। এ ঘটনা সত্যি হলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কে চির ধরতে পারে। তবে এক ব্যক্তির সঙ্গে দলকে টানা ঠিক হবে না। বিএনপি এটাকে সমর্থন করে না। যা দল থেকে সংবাদ সম্মেলনেই স্পষ্ট করা হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, আসলাম চৌধুরীর বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ফেসবুকে পাওয়া ছবি নিয়ে তারা তদন্ত করছে। বৈঠকের সত্যতা পেলে আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে। যে কোনো সময় তাকে গ্রেফতারও করা হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক কোনো সম্পর্ক রাখাই দণ্ডনীয় অপরাধ।  এ প্রসঙ্গে আসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি। পালিয়ে থাকার সুযোগ নেই। আমি জেনেশুনে কোনো অপরাধ করিনি। তাই গ্রেফতারকে আমি ভয় পাই না।’

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে বিএনপি ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সরকারের কাছে খবর রয়েছে যে, তারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ মুসলিম  দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। তারা ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে যে, বিএনপি ক্ষমতায়  গেলে  দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে। এটা যে কত বড় অপরাধ! আমার মনে হয়, এখন সময় এসেছে এসব সাক্ষ্য-প্রমাণকে এক জায়গায় করার।

এদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে বিএনপি নেতার সঙ্গে ইসরায়েলি লিকুদ পার্টির এক ইহুদি নেতার সাক্ষাতের খবরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ফিলিস্তিন। ঢাকায় ফিলিস্তিনি দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ইউসুফ এস রামাদান গণমাধ্যমে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এ ধরনের সাক্ষাৎ প্রকারান্তরে সব ফিলিস্তিনি শিশু ও নরনারীর পিঠে ছুরিকাঘাতের শামিল, যা ঢাকার ফিলিস্তিন দূতাবাসকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছে।

কে এই আসলাম চৌধুরী : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা আসলাম চৌধুরী। পারিবারিকভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে আসলাম চৌধুরী ২০০৩-০৪ সালে জিয়া পরিষদের মাধ্যমে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অবস্থায় কোনো ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলেছেন। ছাত্রজীবনের পর তিনি কনফিডেন্স সিমেন্টের অ্যাকাউন্ট্যান্ড ছিলেন। এর এমডি ছিলেন রূপম কিশোর বড়ুয়া, যিনি লায়ন্সের গভর্নরও ছিলেন। সেখান থেকেই আসলামের ব্যবসায়িক উত্থান শুরু। এরপর তিনি লায়ন্সেরও গভর্নর হন।

ওয়ান-ইলেভেনে তিনি বিএনপির পক্ষে কাজ করেন। এরপর ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়নও পান। ২০০৯ সালে দলের জাতীয় কাউন্সিলের পর চট্টগ্রাম উত্তর জেলার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও একপর্যায়ে আহ্বায়কের দায়িত্বও পান। ওই সময় কমিটি গঠনের একক ক্ষমতা তাকে দেন দলের চেয়ারপারসন। বিগত আন্দোলনেও সীতাকুণ্ডে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে হাল ধরেন আসলাম চৌধুরী। এরই পুরস্কারস্বরূপ তাকে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে আসলামের ঘনিষ্ঠজনরা জানান।

তবে রাতারাতি তার পদোন্নতিতে চট্টগ্রাম বিএনপির বড় একটি অংশই ক্ষুব্ধ। চট্টগ্রামের এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতি করেও যা পাইনি, মাত্র কয়েক বছরের রাজনীতিতেই আসলাম চৌধুরী পদোন্নতি পেয়েছেন। এতে দলের চেইন অব কমান্ড থাকে না।-বিডি প্রতিদিন

১৪ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে