সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬, ১২:৫০:৩৭

ইউনিয়নেও মনোনয়ন বাণিজ্য

ইউনিয়নেও মনোনয়ন বাণিজ্য

নূরে আলম সিদ্দিকী: সম্প্রতি ৪টি ধাপে ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল সেই নির্বাচনটিকে সত্যের খাতিরে ভোটবিহীন বলা যাবে না। পাশাপাশি সংঘর্ষে নিহত ও আহতের সংখ্যা আতঙ্কজনক, ভয়াবহ। এই নির্বাচন যদি একটু নিরপেক্ষ অথবা যোগ্যতার মাপকাঠিতে একটুখানি নিরপেক্ষ যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারতো তাহলে দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের সূচনা করতে পারতো। সরকারের একটি শক্ত যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ হতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা নেই। নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে প্রদেয় শক্তি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা, ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্যের সীমাহীন ও নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ সেই প্রাতিষ্ঠানিকতাকে  আদৌ প্রতিস্থাপিত তো করেইনি, বরং দেশে-বিদেশে আরো উদগ্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে কোনো নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে। এটা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতার পথে হিমাচলের মতো সুদৃঢ় প্রতিবন্ধকতাই নিষ্ঠুরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং তাদের অবস্থান সমাজে এতটাই হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে যে, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তো দূরে থাক, একটি চৌকিদারও তাদের হুকুম তামিল করেনি। যার ফলশ্রুতিতে খুন ও জখমের এই বিশাল অংকটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৪টি ধাপের নির্বাচনে মোট নিহতের সংখ্যা ৮৪!
চলমান ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা এমন- প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগ-৪৯৫, বিএনপি-৫০ স্বতন্ত্র-১০৯। দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগ-৪৪৪, বিএনপি-৬৩, স্বতন্ত্র-১১৭। তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগ-৩২৪, বিএনপি-৫৭, স্বতন্ত্র-১২১। চতুর্থ ধাপে আওয়ামী লীগ-৪৪০, বিএনপি-৭০, স্বতন্ত্র-১৬১। বাকিগুলো পেয়েছে অন্যরা।

এর মধ্যে চার ধাপে আওয়ামী লীগের মোট ১৬০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ৩৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিরোধী দল বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের কোনো সুযোগই সেখানে ছিল না; বরং পরিবেশটি অকল্পনীয় বীভৎস ছিল। এটি আর যাই হোক, ক্ষমতাসীনদের দাম্ভিকতা এবং অসহযোগিতার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তবুও এ নির্বাচনটি নির্বাচন কমিশনের যতই নির্লজ্জতা প্রকাশ করুক না কেন, এই সত্যটি আবারও প্রমাণ করলো, গণতন্ত্রে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

এককালে যারা বিপ্লবের প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করেছেন, কালের প্রবাহিত স্রোতধারায় তারাই আজকে সমস্ত বৈপ্লবিক চেতনার মাথা খেয়ে স্তাবক, তোষামোদকারী এবং দালালিতে শুধু লিপ্তই হননি, বরং বিশ্বের নিকৃষ্টতম ও ন্যক্কারজনক রেকর্ড তৈরি করেছেন। তাদের নান্দনিক তোষামোদিতে শেখ হাসিনা এতখানি বিভ্রান্ত হয়েছেন যে, তিনি নিজেকে হয়তো মৃত্যুঞ্জয়ী ভাবতে শুরু করেছেন। ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা আজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদিও এই তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশনের তেলেসমাতিতে বেলছড়ি ইউপি নির্বাচনে যেখানে ভোটার সংখ্যা ৩১২৮ সেখানে ভোট পড়েছে ৬১৩৫টি। এ ব্যাপারে ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এতে তারা যে কতখানি দুর্বল সেটিই উৎকটভাবে প্রমাণিত হয়েছে।


গণতান্ত্রিক লাজলজ্জা বিবর্জিত এই নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত প্রিজাইডিং অফিসারদের প্রকাশ্যে সিল মারতে দেখে কর্তব্যরত র‌্যাব ও পুলিশ অনেককে গ্রেপ্তার করতেও বাধ্য হয়েছে। তবুও আমি নির্বাচনকেই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রধান পথ মনে করি। তবে নির্বাচনটিতে সব দলের প্রচার-প্রচারণায় সমান সুযোগ থাকতে হবে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো দল বা প্রার্থী যেন প্রশাসনের রক্তচক্ষুর শিকার না হন, গ্রেপ্তার অথবা মিথ্যা মামলার আসামি না হন, সেসব দিকেও সজাগ ও সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। নইলে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা তো থাকবেই না, সামাজিক বিপর্যয় ছাড়া রাজনীতিতে বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকবে না।

৫ই জানুয়ারির একপাক্ষিক ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন জোট আজও মুক্ত অর্থনীতির পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিশ্বের আস্থা অর্জনে সক্ষম হননি। উন্নয়নের সাহায্য সহযোগিতায় তাদের নির্বিকার নির্লিপ্ততা দেশের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড বিরূপ প্রভাব প্রতীয়মান হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন জোটের বাগাড়ম্বরতা একটুও থামেনি।
এই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমার কাছে পরিলক্ষিত হয়েছে অথর্ব নির্বাচন কমিশন, দলকানা প্রশাসন, নির্বাচনে বিরোধীদলীয় জোট ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের পাহাড়তুল্য অন্তরায় সত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে মানুষের ভোট প্রদানের আগ্রহের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবং নৌকার প্রতিপক্ষের বিজয়ীর সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশিষ্ট নির্বাচনগুলো একটু নিরপেক্ষ হলে এবং নির্বাচন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার যোগ্যতা দেখাতে পারলে, স্তাবক মোসাহেবরা যাই বলুক না কেন এবং ফলাফল যাই হোক না কেন, ক্ষমতাসীনদের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও অমলিন হবে।


বিবৃত সবকিছুর পরও গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ক্ষতবিক্ষত করেছে প্রকাশ্য মনোনয়ন বাণিজ্য। তৃণমূল কর্মীর যোগ্যতাকে বিবেচনায় না এনে শুধুমাত্র টাকার জোরে যারা মনোনয়ন ক্রয় করেছেন, তারা যোগ্য ও জনগণের আস্থাভাজনদের কেবল ল্যাঙ মারতেই সক্ষম হননি বরং এমনও শোনা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ৬০-৭০ এমনকি ৮০ লক্ষ বা কোটির অঙ্কও ছাড়িয়ে মনোনয়ন বাগিয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই নির্বোধ নন। অর্থের হিসাবে তারা পরিপক্ব বলেই এই টাকা উসুল করার পরিকল্পনা তাদের আছে। আমি সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি, অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো এই সামাজিক অবকাঠামোয় দুর্নীতি কেবল হবে না, অপ্রতিরোধ্য হবে।

এই মনোনয়ন বেচাকেনার প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক সংঘর্ষ যেটা শুরু হয়েছে সেটা শেষ হবে কিনা সন্দেহ, বরং বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। দেশে আজ আইনের শাসন নেই, পুলিশ ও প্রশাসনকে যে নিজের পক্ষে রাখতে পারে, তার এলাকায় সে-ই রাজা। দেশের সর্বস্তরের মানুষ শুধু ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের দুই দাম্ভিক নেতৃত্ব ছাড়া সবাই আজ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অথচ এটা নিরসনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য দুই নেত্রীর কাছে বলার মতো সাহস দুই দলের কারোরই নেই। বারাক ওবামা হিরোশিমা নাগাসাকিতে যেতে পারেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রোও তার অনুজের আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষরকে সমর্থন প্রদান করেন। ভিয়েতনাম আমেরিকার অর্থায়নে আজকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগ বাড়াতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, মুক্ত অর্থনীতির পাশ্চাত্য দেশসমূহ থেকে শুরু করে চায়না পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন। এবং পাকিস্তানের অনেক হিংসাত্মক পদক্ষেপ সত্ত্বেও একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছেন। সেখানে আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন নেত্রী ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্যাকিং থেকে শুরু করে ভারতের কাছ থেকে আমাদের পাওনা আদায়ের নিমিত্তে কোনো গোলটেবিল ডাকতে চান না।

একুশে আগস্টের বিভীষিকা আমাকেও দগ্ধ করে, করছে এবং বিচার না হওয়া পর্যন্ত করবে। আশু বিচার আমার কাম্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিষয়ে দুই জোটের দুই মেরুতে অবস্থান নিশ্চয়ই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে না। বিদেশি সাহায্য ও বিনিয়োগ আকর্ষণেও বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করবে। আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে ভাবি, বল্গাহীন দুর্নীতি, বিশেষ করে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, যুবক, বেসিক ব্যাংক সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়া এত নিস্পৃহ কেন যারা ক্ষমতায় আছেন, অথবা ক্ষমতায় আসার নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন, তারা যে কতটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের বেদিমূল তৈরি করছেন তা হয়তো তারা উপলব্ধিই করেন না। এভাবে চলতে থাকলে দেশ ও রাজনীতির কথা না ভেবে ওই তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সবার আরাধ্য বিষয় হবে- আদর্শ নয়, কেবলই অর্থ। বিষয়টিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ছাড়া এবং এই দুর্বিষহ পরিবেশ থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া ছাড়া আমাদের মতো দল-বিযুক্ত মানুষগুলোর আর কিইবা করার আছে।-এমজমিন

১৬ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে