সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬, ১০:৩৪:১৮

ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস আজ, আমরা কি ভুলতে বসেছি?

ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস আজ, আমরা কি ভুলতে বসেছি?

নিউজ ডেস্ক : আজ ১৬ মে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এই দিন এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠে দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।

ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারতবিরোধী স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। দুপুর ২টায় হাজার হাজার মানুষের স্রোত গোদাগাড়ির প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাতযাপনের জন্য সে দিনের মতো শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করে পরদিন সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে।

ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে অস্থায়ী সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।

মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’

মাওলানা ভাসানী সেখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভিত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে।

ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী সেদিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন তিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই সাহসী উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে আজো। ভারতের একতরফা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে।

বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা পানির অভাবে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত নদী আজ বিলুপ্তির পথে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে স্থানভেদে ২৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

সূত্র জানায়, যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও তাতে কোনো সুফল আসেনি, দীর্ঘ দিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রুপে নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিচ্ছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজশাহী পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল চর পড়েছে। সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে, গরু-মহিষের গাড়ি চলছে। কোথাও কোথাও ফল ও ফসলের আবাদ হচ্ছে। হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। পদ্মার সেই অপরূপ যৌবন ও সৌন্দর্য আর নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মরুকরণ দেখা দেবে। জীবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চের প্রস্তুতির সময় বিশ্ব নেতাদের এ সম্পর্কে অবহিত করে বার্তা পাঠান। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, চীনের নেতা মাও সেতুং, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন প্রমুখের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে ভারতের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে গঙ্গার পানি বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন।
এ ছাড়া মওলানা ভাসানী জনসভা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফারাক্কার ফলে বাংলাদেশে এরই মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা সরেজমিন দেখতে আসার আহ্বান জানান।

স্থানীয়রা বলছেন, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বৃহৎ একটি অংশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ভারতের একগুয়েমি ও অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে বাংলাদেশ আজ চরম তির শিকার। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমা বেঁধেছে। বছর পাঁচেক আগে থেকে দাবি উঠেছে ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের যে তি হয়েছে, সেই তিপূরণ ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সেই তিপূরণ আদায়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার দাবি জানানো হয়।

সূত্র জানায়, ফারাক্কা বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প কারখানাসহ সব কিছুতেই মারাত্মক ক্ষতি করেছে। তবে এসব ক্ষতির বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন সূত্রে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন- রাজশাহী’ আয়োজিত সাধারণ সভায় একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়।

ওই ঘোষণাপত্রের একটি অংশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে আরো একটি হলো- উত্তরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছ। আর দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষ ও এক তৃতীয়াংশ এলাকা সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রাজশাহীতে আজ গণজমায়েত:
ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ বিপর্যয় এবং অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সে সম্পর্কে দেশবাসীর কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে ও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে রাজশাহীতে বিশাল গণজমায়েতের আয়োজন করা হয়েছে। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় নগরীর পাঠানপাড়া লালন শাহ মুক্ত মঞ্চে এ গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হবে। ফারাক্কা লংমার্চ দিবস পালন কমিটি রাজশাহী এ গণ-জমায়েতের আয়োজন করেছে। এতে বক্তব্য দেবেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. জসিম উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, কবি ও গবেষক ফরহাদ মজহার, প্রকৌশলী এম ইনামুল হক প্রমুখ। ইন্টারেনট
১৬ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে