বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬, ০৩:৩১:১০

জীবনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃত্যু

জীবনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃত্যু

নঈম নিজাম: বেদনার রং কি? আমার এক বন্ধু বললেন নীল। এত সুন্দর একটা রং বেদনার প্রতীক হবে কেন? বেদনা তো দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আর অনুভবের তো কোনো রং থাকে না, বেদনার রং আছে শুধু গানে, কবিতায়, আবেগে। বাস্তবে নয়। তবুও মানুষ সব সময় বাস্তবে থাকে না। কারণ সুখ মানুষের সহ্য হয় না। তাই মাঝে মাঝে ডেকে আনে অ-সুখ, দুঃখ বিলাস।  সব সময় মানুষ দুঃখ নিজে ডেকে আনে বিষয়টি তেমন নয়। অকারণে অপরের যন্ত্রণায় দাহ হয় মানুষ। কিছু মানুষ নিজে জ্বলতে পছন্দ করে। কিছু মানুষ অপরকে দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে আনন্দ অনুভব করে। অদেখা আগুনের ছাই দেখে উচ্ছ্বসিত হয়। মানুষ কেন এমন হয়? অপরের রক্তক্ষরণ, কষ্ট দেখে আপ্লুত হয়? এ নিয়ে মার্টিন লুথার কিং-এর একটি ব্যাখ্যা আছে।

মার্টিন বলেছেন, ‘কিছু মানুষ তোমাকে পছন্দ করে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে তুমি তার কোনো ক্ষতি করেছ। তবুও তুমি তার কাছে স্রেফ অপছন্দের মানুষ। তোমার হাঁটাচলা, অনেকের কাছেই ভালো লাগবে না। কেউ হয়তো তোমাকে অপছন্দ করে, কারণ তুমি তার চেয়ে ভালো কাজ জান। তুমি জনপ্রিয়, তোমাকে লোকে পছন্দ করে, সেটাও অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ হতে পারে। তোমার চুল তার চেয়ে সামান্য বড় বা ছোট, তোমার গায়ের রং তার চেয়ে খানিকটা উজ্জ্বল কিংবা অনুজ্জ্বল হয়তো কারণটা এমন। কেবল কারও যে ক্ষতি করলে তুমি কারও অপছন্দের পাত্র হবে, তা নয়। অপছন্দ ব্যাপারটা আসে ঈর্ষাকাতরতা থেকে। মানুষের সহজাত চরিত্রেই এ অনুভূতির প্রভাব আছে।’ সমাজে যিনি যত বড় তার মন তত ছোট।

মনটাকে আমরা বড় করতে পারি না। সমুদ্রের ঢেউ দেখি। পাহাড়কে আলিঙ্গন করি। কিন্তু মনটাকে বড় করি না। সমাজে সহজভাবে সবাই সব কিছু পেতে চান। ছুঁতে চান। অকারণে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে আড়াল করেন। ব্যস্ত হন নিজের শিকারে। মূল্যবোধের জায়গাগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভাবেন না দুই দিনের দুনিয়াতে এত লড়াই করে কী হবে? চিন্তাও করেন না কোথায় ছিলাম, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি? জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী এক মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে। ধুলোয় মিশে যেতে পারি আমরা। আমার এসব ভাবনা তৈরি হয়েছে কিছু মানুষের অকারণে যন্ত্রণা তৈরি করতে দেখে অথবা হুটহাট করে মানুষের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা দেখে।

মৃত্যুভাবনা নিয়ে এর আগেও লিখেছিলাম। মৃত্যুর মতো বাস্তবতা আমরা কেউই মানতে রাজি নই। তবুও মেনে নিতে হয়। এর আগেও মৃত্যু ভাবনা নিয়ে লিখেছিলাম। অনেক পাঠক ফোন করেছিলেন। অনেকে আপ্লুত হয়েছেন। আগের লেখায়ও বোঝাতে চেয়েছি দুনিয়াটা ক্ষণিকের। কত দ্রুত মানুষ চলে যাবে নিজেও জানে না। জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। এক সময় নির্মল সেন লিখেছিলেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। এখানে কে কার গ্যারান্টি দেবে? ঘরের ভিতরে মানুষ নিরাপদ নয়। বাইরেও না। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা নেই। খাবারে, ওষুধে ভেজাল মেশানো হয়। আর্তমানবতা বলে কিছু নেই। মানুষের মমত্ববোধ বলে কিছু নেই। মাসতিনেক আগের কথা। খুব ভোর রাতে ঘুম ভাঙে ভাগ্নির ফোনে। একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করছে সে। বলল মামা, আব্বাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেছি। আপনি একটু আসুন। আমার পিঠাপিঠি এই বোনের স্বামীর নাম নুরুল আবসার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে পাস করে ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানায় যোগ দেন। বছর দুই আগে প্রধান কেমিস্ট হিসেবে এলপিআরে যান। তার বড় মেয়েজামাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভাগ্নি পিএইচডি করছে জাপানে স্বামীর সঙ্গে। ভাগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করার পর একটি বেসরকারি টেলিফোন কোম্পানিতে কাজ করছে।

এত ভোরে কোন হাসপাতালে নেবে বুঝতে না পেরে প্রথমে নিয়ে যায় মিরপুরের একটি হৃদরোগ হাসপাতালে। সেখানে তারা রাখলেন না। তারপর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। হঠাৎ ভাগ্নির ফোনে আঁতকে উঠলাম। হৃদরোগে না নিয়ে অন্য কোনো বেসরকারি হাসপাতালে কেন নিল না তা নিয়ে প্রশ্ন করলাম না সেই মুহূর্তে। দ্রুত ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমার স্বাস্থ্য বিভাগে ভালো জানাশোনা নেই। তাই এই ভোরে ঘুম ভাঙালাম বন্ধু সৈয়দ বোরহান কবীরের। তাকে দিয়ে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালককে ফোন করালাম। জানলাম তিনি আসছেন।

হাসপাতালে গিয়ে দেখি এই সকালে এলাহি কাণ্ড! একজন রোগী আইসিসিইউতে যাচ্ছেন ভালোভাবে কিছুক্ষণ পর লাশ হিসেবে বের হচ্ছেন। পরিবারগুলো কান্নাকাটি করছে। তারপর চলে যাচ্ছে। কোনোমতে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে প্রবেশ করলাম। আমার বোন বললেন, তিনি একটু আগেও কথা বলেছেন। সবাইকে বলেছেন নাস্তা খেয়ে নিতে। ডাক্তার একটি ইনজেকশন দিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে হয় ঘুমাচ্ছেন। আমরা তখনো বুঝতে পারিনি, এই ঘুম শেষ ঘুম। কিছুক্ষণ পর পরিচালক সাহেব এলেন। আমাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। দেখালেন কীভাবে ফ্লোরে পড়ে আছে রোগীরা। হার্টের রোগীদের ফেলে রাখা হয়েছে যেখানে সেখানে। না আছে অক্সিজেন, না আছে ঠিকভাবে রাখার ব্যবস্থা। দুই তরুণ বয়সী ডাক্তার ও দুই নার্স গলদঘর্ম রোগী সামলাতে গিয়ে। পরিচালকের দিকে তাকালাম আমি।

তিনি বললেন, আপনি ভাগ্যবান। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করুন, আপনার বোনের স্বামীকে একটি বেড দিতে পেরেছি। আমি শোকরিয়া আদায় করলাম মনে মনে। ভাবলাম রোগী আউট অব ডেঞ্জার। তাকে বললাম, কোনো অক্সিজেন নেই কেন? সবখানে থাকে। তিনি বললেন, আর বলবেন না, এত রোগী কীভাবে সামলাবে আমার লোকজন, মাত্র একশ রোগীর জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তা এটা হয়েছে আমার অনুরোধে। তাকে ধন্যবাদ জানালাম রোগীদের প্রতি এত ভালোবাসার জন্য। এরপর তিনি বললেন, আসুন আপনাকে হাসপাতাল দেখাই। আমি তার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকলাম। পরিচালক সাহেব হাঁটছেন। আর দুই নিরাপত্তা কর্মী আগে পিছে বাঁশি ফুঁ দিচ্ছে। বাঁশি ফুঁ দিয়ে রোগীর আত্মীয়স্বজনকে সরাচ্ছে। পরে জানলাম, বাঁশি ফুঁ দেওয়া পরিচালকের প্রটোকল।

বিস্ময় নিয়ে একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা দেখছি। হাসপাতালটি হার্টের রোগীদের জন্য। অথচ চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বারান্দায়, মেঝেতে হৃদরোগের রোগী শুয়ে আছে। কেউ মাদুর বিছিয়ে, কেউ কোনোমতে একটি বিছানা চাদর পেয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের অবস্থা বেহাল। সব দেখে মন ভেঙে গেল। সব শেষে পরিচালকের কক্ষে গেলাম। পরিবেশ দেখে আমি ভীত। পরিচালক মহোদয়কে বিনীত অনুরোধ করলাম, পরিবেশ দেখে আমি ভয় পাচ্ছি। একটু অবস্থার উন্নতি হলে আমার রোগীকে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিন। আসলে এই ভোরে কোন হাসপাতালে নেবে বুঝতে না পেরে আমার বোন ও ভাগ্নি এখানে এসেছে। প্লিজ ভাই একটু দেখবেন। তিনি আশ্বাস দিলেন। আমি হাসপাতাল থেকে বের হলাম নাস্তা খেতে। সঙ্গে ফরিদা। আমরা বের হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই ফোন এলো হাসপাতাল থেকে। ডুকরে কেঁদে উঠল ভাগ্নিটি। বলল, বাবা আর নেই। আমি ধমক দিয়ে বললাম, কাঁদিস কেন? এটা কি ডাক্তার বলছে, না তোর কথা। ও বলল, বাবার হাত আমার হাতে। আমি বুঝতে পারছি। আমি বললাম, ডাক্তার ডাকো। আমি আসছি। অনেক কষ্টে ডেকে ডাক্তারকে তারা আনল।

ডাক্তার ঘোষণা দিলেন, তিনি আর নেই। ফিরে এলাম হাসপাতালে। নিচে দাঁড়িয়ে ভাগ্নে ও মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার শ্যালক অন্য আত্মীয়স্বজন। বলল, মৃত্যু ঘোষণা দিয়ে লাশ মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসকরা একটি বেড খালি করতে পেরে আনন্দিত। দেখলাম, দোতলার আইসিসিইউ থেকে সমানে লাশ বের হচ্ছে। সকালে একজন সুস্থ মানুষকে হেঁটে প্রবেশ করতে দেখেছিলাম। তার লাশও এর মাঝে বের হয়েছে। একজন বললেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসার তেমন সুযোগ নেই। অসহায় রোগীরা আল্লাহ ভরসা নিয়ে থাকেন। বেঁচে থাকলে ভালো। চলে গেলে তো কথা নেই। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। এর মাঝে আমার অফিসের সহকর্মীরা এসে সব কিছুর হাল ধরেন অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে। লাশ মর্গ থেকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো কুমিল্লায় নেওয়ার জন্য। আমি তাকাতে পারলাম না।

এবার আরেকটি মৃত্যুর কাহিনী। গৌতম সাহা আমার বন্ধু। তার সঙ্গে পরিচয় আশির দশকের মাঝামাঝি। কবি সালেম সুলেরী তখন সাপ্তাহিক সন্দ্বীপের সম্পাদক। মুস্তাফিজুর রহমান পত্রিকাটির মালিক। আমি তখনো ছাত্র, পাশাপাশি মাত্র লেখালেখি শুরু করেছি। গৌতম ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। ’৯০ সালের শেষে আজকের কাগজে যোগ দেওয়ার পর গৌতম আমার কাছে মাঝে মাঝে আসতেন। লায়ন্স ক্লাবের কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি থাকত তার সঙ্গে। আমি প্রকাশ করতাম। ’৯৬ সালের পর গৌতম বললেন, চল বিদেশ ঘুরে বেড়াই। জীবন দুই দিনের জন্য। আজ আছি কাল নেই। আমি মহাউৎসাহে তার এই মিশনে যোগ দিলাম। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন নুরুল ইসলাম ভাই। ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। প্রথমে গেলাম ব্যাংকক। তারপর আরব আমিরাত। এরপর লন্ডন, সুইজারল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া। ২০০১ সালের পর আমি এটিএন বাংলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। গৌতমের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। তারপরও দেখা হতো। কথা হতো। গৌতম ফোন করতেন মাঝে মাঝে। সম্পর্ক নষ্ট করার সুযোগ দিতেন না। সেই গৌতম হঠাৎ চলে গেলেন। গিয়েছিলেন ব্যাংকক। সেখান থেকে যাওয়ার কথা সিঙ্গাপুর। গৌতমের জন্য সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে একজন এলেন রিসিভ করতে। কিন্তু গৌতম নেই। ঢাকায় জানালেন তিনি গৌতম সিঙ্গাপুর যাননি।

৩০ এপ্রিল সকালে আমি যাচ্ছি মিয়ানমার। পয়লা মে অফিস বন্ধ। ২ মে ফিরে আসব। বিমানে ওঠার মুহূর্তে ফোন পেলাম সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপনের। আমাদের জমানার ছাত্রনেতা। বললেন, একটা খারাপ খবর আছে। গৌতম ব্যাংকক থেকে মিসিং। মন খারাপ করেই বিমানে চড়লাম। মিয়ানমারে বসেই শুনলাম, ব্যাংককে গৌতম দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট শেষ করে বের হলেন। ভাবলেন, এখনো কিছু সময় আছে হাতে। শপিং করা যায়। রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দেয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন গৌতম। জ্ঞান হারালেন। তাকে থাই পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেই জ্ঞান আর ফিরল না। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়লেন। তারপর চলে গেলেন। আহারে মানুষের মৃত্যু কত সহজ!

মৃত্যুকে আমরা মানতে নারাজ। কিন্তু মৃত্যু আমাদের জীবনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে কখন চলে যাব কেউই জানি না। এই জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হয়, দুনিয়াতে এত লড়াই করে কী হবে? ক্ষমতা ক্ষণিকের বিষয়। মানুষ চলে গেলে কোনো কিছুই থাকে না। সবকিছু একজন মানুষের সঙ্গে চলে যায়।  আগের দিনে মানুষের মৃত্যুর পর তার কফিনে দামি অলঙ্কার দিয়ে দেওয়া হতো। কেন দেওয়া হতো তা এখনো অপার রহস্য। মৃত্যুকে মেনেই বেঁচে থাকলে সমস্যা কমে যায়।  লড়াই থাকে না। যুদ্ধ থাকে না।-বিডি প্রতিদিন

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

১৮ মে ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে