বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬, ০৭:০২:০৩

আঁধার ঘরে চাঁদের আলো

আঁধার ঘরে চাঁদের আলো

নিউজ ডেস্ক: অনেকের ভাগ্যে জোটেনি স্কুলে যাওয়ার ভালো পোশাক, জোটেনি বই কলম খাতা। কেউবা দিতে পারেনি স্কুলের বেতন। পায়নি প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়ার সুযোগ। জোটেনি এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন। তারপরও দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে জিপিএ-৫।

কৃষকের ছেলে শামীম। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার মথুরাপাড়া গ্রামের মো. শামীম নানশ্রী হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অভাবের তাড়নায় কৃষক বাবা ভিটেবাড়ি বিক্রি করে ঢাকায় চলে যান। মা গার্মেন্টসে চাকরি নেন। মেধাবী সন্তান শামীম দরিদ্রতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে শামীম বড়। ছোট ভাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। মেধাবী ছাত্র বলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটি শামীমকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেয়। লেখাপড়া করে শামীম ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভাব। অর্থের অভাবে তার আশা আদৌ পূরণ হবে কিনা সে জানে না।

মোরসালিন: দরিদ্রের এবং অভাবের সাথে ‍যুদ্ধ করে এম মোরসালিন এবছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। চলনবিলের নিভৃত পল্লী হান্ডিয়াল গ্রামের আব্দুস সালাম ও মুনমুন খাতুনের ছেলে মোরসালিন পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছিল। হান্ডিয়াল বাজারে সোয়া এক ডেসিমাল জায়গার একটি ঘরই তাদের একমাত্র সম্বল। মোরসালিন ভালো ফলাফল করেও ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার চিন্তায় দিশেহারা। তার স্বপ্ন বুয়েটে লেখাপড়া করার কিন্তু অভাবের তাড়নায় সে স্বপ্ন চুরমার হতে চলেছে।

আবিদা: দারিদ্র্য জয় করে এবারের এসএসসিতে মেধাবী আবিদা সুলতানা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে কলারোয়া উপজেলার চান্দুড়িয়া গ্রামের ভূমিহীন ভ্যান চালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের মেয়ে। সে ২০১৩ সালে জেএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। আবিদার মা পারুল আক্তার জানান, নিজেদের জমি না থাকায় অন্যের জমিতে খুপরি ঘর বেঁধে বসবাস করেন। তার একমাত্র ছেলে বাবার সঙ্গে ভ্যান ঠেলার কাজ করে। অবসরে একমাত্র মেয়ে আবিদা তার সঙ্গে অন্যের বাড়িতে থালা-বাসন পরিষ্কারের কাজ করে। অভাবের কারণে বই কিনে দিতে পারেনি। সে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সাহায্য নিয়ে লেখাপড়া করেছে। আবিদা সুলতানা ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে মানব সেবা করতে চায়। দরিদ্রতা তাকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন তার নিয়তি।

পাপিয়া: ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পা দেওয়ার পর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বাবা। সেই থেকে মা পরের বাড়িতে করেন ঝি এর কাজ। অভাব-অনটনের মধ্যেও বন্ধ হয়নি তার লেখাপড়া। সে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ভাতঘরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।  সে রায়গ্রাম ইউনিয়নের জটারপাড়া গ্রামের মৃত জালাল উদ্দিনের একমাত্র মেয়ে। পাপিয়ার মা মমেনা বেগম বললেন, অর্থের অভাবে মেয়ের উচ্চশিক্ষার দরজা এবার হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, কারো একটু সহযোগিতা পেলেই মেধাবী পাপিয়া একদিন অনেক বড় কিছু করে দেখাতে পারবে।

হাসান: ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার ছোনাউটা গ্রামের মো. আলম ফরাজীর ছেলে মো. হাসান ফরাজী দরিদ্রতাকে হার মানিয়ে আমুয়া বন্দর আমীর মোল্লা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাবা অন্যের বাড়িতে ধান মাড়াইয়ের কাজ করে সাত জনের সংসার চালান। হাসান পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে ক্লাস করতো। বিদ্যুত না থাকায় কুপির আলোতে লেখাপড়া করতো। পাশাপাশি মাঝে মাঝে স্কুলে না গিয়ে বাবার সাথে কাজ করতো। মা লাল মতি বেগম জানান, হাসানের মেঝ ভাই আলিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে, অপর ভাই হোসেন ৭ম শ্রেণিতে ও বোন আয়েশা ১ম শ্রেণিতে  পড়ে। চার সন্তানের খরচ চালানো তাদের জন্য দুঃসাধ্য কাজ। হাসান প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসিতে জিপিএ-৫ সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ছেলের ফলাফলে বাবা-মা মহাখুশি হলেও ছেলেকে কলেজে ভর্তির চিন্তা হতাশা এনে দিয়েছে। হাসান ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায়।

আবার এদিকে নাগেশ্বরীর তিন হত-দরিদ্র এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অভাব ও দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে অভাবী পরিবারের তিন মেয়ে ভিতরবন্দ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সাফল্য পেলেও অর্থাভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে তারা পৌঁছাতে পারবে কিনা জানে না।

নূরুন্নেছা: বর্গা জমি চাষ করে উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের বাহারবন্দ গ্রামের ভূমিহীন নূরজামাল মিয়া সংসার চালান। বাঁচার লড়াইয়ে স্ত্রী মাহমুদা মাঝে মাঝে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। অভাবের সাথে লড়াই করে কুপির আলোয় লেখাপড়া করেছে নূরুন্নেছা। এভাবে পড়ালেখা করে ভিতরবন্দ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ভবিষ্যতে সে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। অর্থাভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কিনা সে তা জানে না।

আফিয়া সিদ্দিকা: একই অবস্থা ভিতরবন্দ নগরপাড়া গ্রামের ভূমিহীন বর্গাচাষি আশরাফ আলী ও খাদিজা বেগমের ছোট মেয়ে আফিয়া সিদ্দিকার। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি ও ভিতরবন্দ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারে জিপিএ-৫ পেলেও তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দরিদ্রতা।

নাহিদা সুলতানা: ভিতরবন্দ গোপালের খামার গ্রামের দিনমজুর নজরুল ইসলাম ও বিলকিস পারভীনের বড় মেয়ে নাহিদা সুলতানা জন্ম থেকে দেখে আসছে দুবেলা দুমুঠো খাবার যোগাড়ের চেষ্টায় বাবা-মার নিরন্তর সংগ্রাম। কোনো কারণে কাজে যেতে না পারলে সেদিন তাদের উপোস কাটে। তাই স্কুল বন্ধ পেলে অনেক সময় মাকে সহযোগিতা করতে তাকেও অন্যের বাড়িতে কাজে যেতে হয়। বাড়িতে ফিরে স্কুলের পড়া তৈরি ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে কুপির আলোয় রাত জেগে পড়ালেখা করে। এভাবেই পড়ালেখা করে ভিতরবন্দ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারে সে জিপিএ-৫ পেলেও অর্থাভাবে তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন মার খাওয়ার আশঙ্কা ভিড় জমিয়েছে চোখে মুখে।-ইত্তেফাক

১৯ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে