নিউজ ডেস্ক : এক শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করিয়ে সমালোচিত জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমানের ফাঁস হয়ে যাওয়া একটি মোবাইল ফোন সংলাপে তাকে জেলার এক সাংবাদিককে গালাগাল করে চাকরি খাওয়ার হুমকি দিতে শোনা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও এনটিভির জেলা প্রতিনিধি নাফিজ আশরাফের চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন তিনি। সংলাপে ‘অশ্রাব্য ভাষায়’ সেলিম ওসমানকে নারায়ণগঞ্জের ‘প্রভাবশালী’ ওসমান পরিবার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ও প্রতিবেদন প্রকাশকারী সাংবাদিকদের বিষয়ে ক্ষোভ ঝাড়তেও শোনা গেছে।
সেলিম ওসমানের সঙ্গে নাফিজ আশরাফের ওই কথোপকথনের একটা বড় অংশ ‘অকথ্য’ ভাষায়। এই প্রতিবেদনে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
ফাঁস হওয়া অডিওতে নাফিজকে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর মালিকানাধীনে এনটিভি থেকে চাকরিচ্যুতির হুমকি দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমান। তবে তার দাবি, তাদের আলাপ ছিল ব্যক্তিগত।
“আমার সঙ্গে ওনার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে আমি অনেক কথা বলেছি। কোনো ধরনের হুমকি-ধামকি আমি সেখান দিই নাই।”
সাধারণ সম্পাদক নাফিজকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে এক সদস্যকে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাব থেকে বহিষ্কার নিয়ে তাদের কথোপকথনের সূত্রপাত।
গত ৬ মে প্রেস ক্লাবের কার্যকরী কমিটির সভায় আমার দেশ পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আবু সাউদ মাসুদকে বহিষ্কার করা হয়।
প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু মাসুদ একই সঙ্গে স্থানীয় পত্রিকা ‘সোজাসাপটা’র প্রকাশক-সম্পাদক এবং ‘নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটনেট’র সম্পাদক।
কথোপকথন কখন হয় তা জানাতে নাফিজ আশরাফ অপারগতা প্রকাশ করলেও সেলিম ওসমান বলেন, “কথা হয়েছে মাসুদকে বহিষ্কারের দুই দিন পর।
তিনি বলেন, “মাসুদ আমার কাছের ছোট ভাই। প্রেস ক্লাবের কার্যকরী কমিটি বহিষ্কার করেছে। এরপর মিটিংয়ে বলা হলো, আমার সম্মতিতে বহিষ্কার করা হয়েছে। এখানে আমার সম্মতির বিষয় আসবে কেন? টেলিফোনে আমি সেই বিষয়টি জানতে চেয়েছি।”
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে একদল লোক মারধর করে। পরে তাকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করান স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান।
দেশজুড়ে ওই ঘটনার প্রতিবাদ ও দোষীদের বিচার দাবির মধ্যেই মঙ্গলবার সেই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানসহ জড়িত অন্যদের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। ওই শিক্ষককে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে ১৪ দল বলেছে, ওই কাজ করে সেলিম ওসমান সাংসদ পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ফাঁস হওয়া রেকর্ড নিয়ে প্রতিবেদন না করারও অনুরোধ এসেছে এই সাংসদের কাছ থেকে।
অডিওতে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি হালিম আজাদকে ইঙ্গিত করে সেলিম ওসমান বলেন, “যে শামীম ওসমানরে খুনি বলছে, তারে সভাপতি পদে বসায় রাখছেন। …আর মাসুদ নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে খারাপ পোলা? মিটিংয়ে বলছেন, আমার কাছ থেকে সম্মতি লইয়া মাসুদরে বহিষ্কার করা হইছে।”
একটা পর্যায়ে নাফিজ বলতে চাচ্ছিলেন, মাসুদ ‘উল্লাপাল্টা’ করছে এ বিষয়টি সেলিম ওসমানকে জানানো হলেও তিনি গুরুত্ব দেননি। ‘আপনাকে আমি বলেছি, আপনি গুরুত্ব দেন নাই।’
“না, আমাকে জানান নাই। একবার তো বলতে পারতেন,” উত্তর দেন সেলিম ওসমান। কথোপকথনে নাফিজ আশরাফ এবং সেলিম ওসমানের ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের’ বিষয়টিও উঠে এসেছে।
প্রেস ক্লাবের সবাই ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে ‘লেগেছে’ - সেলিমের এমন অভিযোগ শুনে নাফিজ বলছিলেন, “দুই-তিনজন ছাড়া বাকিরা আপনাদের দুই ভাইকে কাভারেজ দিই।”
তখন সেলিম ওসমান আরও উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, “কাভারেজ দিয়েন না আজকে থেকে। আমি কাভারেজের … মারি। কাভারেজ যাবে আমার কালের কণ্ঠ আছে, কাভারেজ যাবে যুগের চিন্তা আছে। কালের কণ্ঠ আপনার এখানে সদস্যপদই পায় না!
‘এনটিভি দিয়া কাভারেজ দিবেন না আপনি? আমি নতুন সাংবাদিক বহায়া দিমু কালকা। না পারলে কালকে ... যায়েন আমার মুখে।’ এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি ‘ত্বকী মঞ্চের’ সদস্যসচিব হালিম আজাদ ও প্রথম আলোর প্রতিনিধি আসিফ হোসেনের বিষয়েও ক্ষোভ ঝাড়েন সেলিম ওসমান।
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জন্য সেলিম ওসমানের ভাই শামীম ওসমানসহ বেশ কয়েকজনকে দায়ী করে আসছেন ত্বকীর বাবা।
কথোপকথনের একটা পর্যায়ে অকথ্য ভাষায় বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান যা বলছিলেন তা এই রকম, “আপনার প্রেসিডেন্ট আমাকে দাওয়াত দিয়া অপমান করছে। তারে বহিষ্কার করেন নাই ক্যান?
‘হেই ত্বকী মঞ্চ লইয়া ৩২টি মিটিং করছে, একটাতেও হামলা হয় নাই। আমি প্রতিশোধপরায়ণ না, প্রতিশোধপরায়ণ হলে আসিফ বাঁইচা থাকতে পারত না।’ এক সময় তিনি এও বলেন, ‘আমি শামীম ওসমান না, প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কথা কমু।’
কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নাফিজ।
তবে মাসুদকে বহিষ্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা তদন্ত করে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাকে বহিষ্কার করা হয়।”
মাসুদকে বহিষ্কার করতে সেলিম ওসমানের ‘সম্মতি’ নেওয়ার প্রসঙ্গ এল কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।”
সেলিম ওসমানের বড় ভাই প্রয়াত নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভাইদের মাঝে মেজ সেলিম ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করলেও পরে মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।
২০১৪ সালের এপ্রিলে নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়। তিনি নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজেরও সভাপতি।
নাসিম ওসমান ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাসিম ওসমানের বাবা একেএম শামসুজ্জোহা ১৯৭৩ সালে ওই আসনেরই সাংসদ ছিলেন। আর ছোট ভাই শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য।
নারায়ণগঞ্জে আসার আগে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে তাদের আবাস ছিল। ১৯০০ সালে জন্ম নেওয়া দাদা খান সাহেব ওসমান আলী ৩০-এর দশকে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৩৫ সালে চাষাঢ়া রেললাইন সংলগ্ন স্থানে তিনি বাড়ি তৈরি করেন, যা বায়তুল আমান নামে পরিচিত। খান সাহেব ওসমান আলী ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।-বিডিনিউজ
১৯ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন