বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬, ০১:০০:৩৮

আমি থাকবো না, ছেলেরেও রাখবো না: সেই মায়ের স্বীকারোক্তি

আমি থাকবো না, ছেলেরেও রাখবো না: সেই মায়ের স্বীকারোক্তি

নিউজ ডেস্ক : দাম্পত্য কলহের কারণে প্রথম বিয়ের সংসারটি ভেঙে যায় ইডেন কলেজের সাবেক ছাত্রী মীর ফাহমিদা মুক্তির। রাজধানীর উত্তরার নর্থ টাওয়ারের কাপড়ের দোকানের কর্মী সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন মুরাদও ছিলেন বিবাহিত। তবে কোনো সন্তান না থাকায় মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগে পরিচয় হয় মুক্তি ও মুরাদের। এরপর প্রণয়। দু’জন তাদের অতীত জীবন জেনেই নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। বিয়ের পর তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে, নিহাল সাদিক।

তবে বিয়ের কয়েক মাস যেতেই তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। মুরাদ প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দেয়ায় মুক্তি সন্দেহ করতে থাকেন- ওই স্ত্রীকে বেশি ভালবাসেন তার স্বামী। আর মুক্তির মোবাইল ফোনে বেশি কথা বলা এবং বাইরে যাওয়া সন্দেহ তৈরি হয় মুরাদের মনে। তিনি বলতে থাকেন, সাবেক স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন মুক্তি। পরিস্থিতি এমন হয় যে, নিহাল তার ওরসজাত সন্তান কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুরাদ। এক পর্যায়ে বিচ্ছেদের জন্য নিহালকে রেখে মুক্তিকে চলে যেতে বলেন মুরাদ। এ নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায় নিজের সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন মুক্তি।

বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে এমনই দাবি করেছেন অভিযুক্ত সেই মা। দেড় বছরের শিশু নিহাল সাদিককে হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত মুক্তিকে আদালতের নির্দেশে দুই দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনি হত্যার দায় স্বীকার করেননি। শেষ মুহূর্তে পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুক্তি একাই তার ছেলেকে বটি দিয়ে পেট কেটে হত্যা করে নিজের গলায়ও আঘাত করেন। এরপর বটির রক্ত মুছে ফেলে রাখেন। মুক্তি জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘ও (মুরাদ) আমাকে বলছে- ছেলেকে রেখে আমি যেন চলে যাই। ওর সন্তান ছিল না। ছেলে পেয়েছে। আমি কী পেলাম? তাই আমি ঠিক করি- আমি থাকবো না; ছেলেরেও রাখবো না। মা না থাকলে ছেলের থাকার কী দরকার!’ বুধবার ঢাকার মহানগর হাকিম এস এম মাসুদ জামান ১৬৪ ধারায় মুক্তির জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে করাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

উত্তরখান থানার ওসি শেখ সিরাজুল হক বলেন, ‘প্রথমে ঘটনা অস্বীকার করে ভিন্ন রকমের কথা বলছিলেন মুক্তি। রিমান্ডের শেষ দিকে পুরো ঘটনা স্বীকার করেন। তিনি নিজের ইচ্ছায় আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হন। দাম্পত্য কলহ ও বিচ্ছেদের পরিস্থিতির কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।’

জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘মুরাদ ও মুক্তি একে অপরকে চরম অবিশ্বাস করতেন। এ কারণে মুক্তিকে চলে যেতে বলেছেন মুরাদ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের ছেলেকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আমাদের কাছে তিনি এভাবেই ঘটনাটি বলেছেন। এরপরও ঘটনায় আর কেউ জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, উত্তরখান থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বটি দিয়ে ছেলের পেট কেটে ওই বটি দিয়েই নিজের গলায় আঘাত করেন মুক্তি। পরে তিনি বটিটি লুকিয়ে রাখেন। তার বক্তব্য ও শনাক্তমতে ওই বটিটি উদ্ধার করেছি আমরা।’

মুক্তি তার জবানবন্দিতে জানান, তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের বালিয়ার গ্রামে। তার বাবার নাম মীর ফেদাউল। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ছোট মুক্তি। তার বড় ভাই মীর ফজলুল বারী রাজধানীর ঝিগাতলায় থাকেন এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ভাইয়ের বাসায় থেকেই লেখাপড়া করতেন মুক্তি। প্রায় এক যুগ আগে শাহীন মাহমুদ নামে একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তবে দু-এক বছর পরই তাদের সম্পর্ক অস্বাভাবিক হয়ে যায়। ওই পক্ষে সায়িমা সুমাইয়া (১১) নামে মুক্তির একটি মেয়ে আছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে শাহীনের সঙ্গে মুক্তির বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে।

মুক্তি ইডেন কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তবে ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার কারণে তার চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়া হয়নি। মুরাদ রাজধানীর উত্তরার নর্থ টাওয়ারের লেডিস কর্নার নামে একটি কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী। প্রায় সাত বছর আগে মুক্তির সঙ্গে তার পরিচয়। মুরাদও আগে বিয়ে করেছেন। তবে প্রথমপক্ষে তার কোনো সন্তান নেই। প্রথম স্ত্রী লিজাকে তিনি তালাক দেননি। লিজা মুরাদের মায়ের সঙ্গে উত্তরার আলাদা বাসায় থাকেন। দুজনই ব্যক্তিগত জীবনের এসব বিষয় জেনেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

তবে মুক্তি সন্দেহ করতেন প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মুরাদের সম্পর্ক আছে। তার চেয়ে ওই স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসেন মুরাদ। মুরাদও সন্দেহ করেন- মুক্তির প্রথম স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি শিশু নিহালের পিতৃপরিচয় নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন মুরাদ। এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এক পর্যায় ওই সন্দেহ কিছুটা দূর হলেও সম্পর্ক রাখতে চাইতেন না মুরাদ।

মুক্তি স্বীকারোক্তিতে বলেন, ঘটনার দিন সকালেও তাদের ঝগড়া হয়। কর্মস্থলে যাওয়ার সময় মুরাদ আবারো ছেলেকে রেখে তাকে চলে যেতে বলেন। এরপর উত্তেজিত হয়ে পড়েন মুক্তি। তিনি মনে করেন- চলে গেলে প্রথমপক্ষের স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে সুখেই থাকবে মুরাদ। আর তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। এমন চিন্তা থেকেই ছেলেকে হত্যার পর আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আলমগীর হোসেন জানান, ঘটনার রাতেই মুক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাক-কান, গলা বিভাগে চিকিৎসার পর মনোরোগ বিভাগেও মুক্তির চিকিৎসা দেয়া হয়। গত ২৯ এপ্রিল তিনি মানসিক ও শারিরিকভাবে সুস্থ্য বলে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল।

ওই দিনই মুক্তিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিন রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ। গত ২ মে শুনানি শেষে তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন আদালত। গত বৃহস্পতিবার থেকে রিমান্ডে নেয়া হয় মুক্তিকে। শনিবার তার তিনদিনের রিমান্ড শেষ হলে রোববার আবারো সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। সেদিন আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
 
গত ১৮ এপ্রিল উত্তরখানে ভাড়া বাসা মাস্টারপাড়া সোসাইটির ৮৫৯ নম্বর জামাল সাহেবের বাড়ির চতুর্থ তলা থেকে নিহালের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করার শিশুটির ভুড়ি বের হয়ে যায়। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা মুরাদ বাদী হয়ে মা মক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। আত্মহত্যার চেষ্টার দায়ে তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে পুলিশ। -বাংলামেইল
১৯ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে