বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০১৬, ১০:৫৩:৩৮

প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামের হাসপাতালেও পুকুরচুরি!

প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামের হাসপাতালেও পুকুরচুরি!

শরীফুল ইসলাম ও রাজবংশী রায় : প্রকল্পের ব্যয় ১৪২ কোটি থেকে বেড়ে ১৮২ কোটি টাকা হয়েছে। দুই দফা বাড়ানো হয়েছে নির্মাণকাজের সময়। কিন্তু নির্মাণের পর ছয় মাস না যেতেই সামান্য বৃষ্টিতে পানি পড়তে শুরু করেছে ভবনের ছাদ থেকে। লাগামছাড়া অনিয়মের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত এ প্রকল্পের সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে। গোপালগঞ্জে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নির্মাণের এ প্রকল্প করতে গিয়ে কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিল ও সিকিউরিটি মানি তুলে নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। বাউন্ডারি দেয়ালটি যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে নির্মিত হাসপাতালের নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হতে দেখে একপর্যায়ে স্থানীয়রাই তা লিখিত ও মৌখিকভাবে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফা তলব করে অনিয়মের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার গ্রুপটির বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলছেন না। তবে দু'জন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার বলেন, 'অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কোনোভাবেই রেহাই পাবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো কাজ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে।'

গোপালগঞ্জে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালের মে মাসে শুরু হয়, যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এটির নির্মাণকাজের মেয়াদ প্রথম দফায় ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু এর পরও কাজ শেষ হয়নি। দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প সম্পন্ন হয় সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী এর উদ্বোধন করেন ২০১৩ সালের নভেম্বরে।

কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার ছয় মাস পেরোনোর পর দেখা যায়, অল্প বৃষ্টি হলেই প্রশাসনিক ভবন কাম একাডেমিক ভবনের ছাদ চুইয়ে পানি পড়ছে। সভাকক্ষের দেয়াল-মেঝেতেও বৃষ্টির পানি জমছে। ভবনটির বাউন্ডারি দেয়ালের প্রতিটি পিলারের সঙ্গে টানা দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি। এ কারণে বাউন্ডারি দেয়াল যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাউন্ডারি দেয়াল পর্যন্ত মাটি ভরাট করার কথা

থাকলেও তা করা হয়নি। বাউন্ডারি দেয়ালসংলগ্ন ৮ থেকে ১০ ফুট জায়গাও ফাঁকা রাখা হয়েছে। ১০০ কিলোওয়াট সোলার প্যানেল লাইট সংযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৬০ কিলোওয়াট সংযোগ দেওয়া হয়েছে ।

মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে :শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালক ডা. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, 'হাসপাতালের সীমানাপ্রাচীরের কিছু জায়গায় জিও টেক না লাগানোয়, তা ছাড়া চারদিকে মাটি ভরাট না করায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের রিজার্ভ ট্যাঙ্ক ছিদ্র হওয়ায় হাসপাতালে পানি সরবরাহে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। পানির পাম্পের জানালাগুলো এখনও লাগানো হয়নি। অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ব্লক, কনফারেন্স রুম ও প্যাথলজিক্যাল কক্ষে জেনারেটর লাইন সংযোগ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। সিসি ক্যামেরা চালু করার পেছনে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে; কিন্তু তাতে স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে না। ছবি বড় করলে ফেটে যাচ্ছে। কয়েকটি আবাসিক কোয়ার্টারের কাজও অসম্পূর্ণ রয়েছে।' এসব অনিয়মের পরও প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

প্রকল্পের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন এমন অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতাল প্রকল্প কাজের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার গ্রুপটি খুবই প্রভাবশালী। এ কারণে প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাই তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এই ঠিকাদার গ্রুপ হাসপাতালের নির্মাণকাজ সম্পন্ন না করেই বিল ও সিকিউরিটি মানি তুলে নিয়েছে। এরই মধ্যে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্পের আওতায় সব কাজ সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত বিল ও জামানতের অর্থ পরিশোধের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকেও কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক বিষয়টি গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরকে জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনা জানার জন্য প্রধানমন্ত্রীও প্রকল্প পরিচালককে তলব করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি বিস্তারিত ঘটনা তুলে ধরেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ডা. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, হাসপাতাল নির্মাণকাজে অনিয়মের কথা জানিয়ে আমি প্রধান প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার চিঠি উপেক্ষা করে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদার গ্রুপ বিল ও সিকিউরিটি মানি তুলে নেয়। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কেও জানাই। এরপর গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।' তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। -সমকাল
২৬ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে