রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬, ০১:৫২:৪৩

শাজাহান সিরাজ ভালো নেই, কথা বলেন ইশারা-ইঙ্গিতে

শাজাহান সিরাজ ভালো নেই, কথা বলেন ইশারা-ইঙ্গিতে

কাজী সুমন: সাবেক ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। একাত্তরের ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের বিশাল ছাত্রসমাবেশে পাঠ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী এ বীর আজ হেরে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধে। তার শরীরে বাসা বেঁধেছে একাধিক জটিল দুরারোগ্য ব্যাধি। চার বছর ধরে বিছানায় কাটছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান এই চরিত্রের। হারিয়ে ফেলেছেন বাকশক্তিও। তিন-তিনবার মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করা এ রাজনীতিবিদ কথা বলছেন অনেকটা ইশারা-ইঙ্গিতে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। মুখ দিয়ে স্বাভাবিক খাবারও খেতে পারছেন না। দুবছর ধরে পেটে লাগানো টিউব দিয়ে তরল খাবার খাচ্ছেন। এতে শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছেন মুক্তির সংগ্রাম-আন্দোলনের চার খলিফার এক খলিফাখ্যাত সাবেক এ ছাত্রনেতা। গুলশানের বাসায় কাটছে ৭৩ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদের জীবনের পড়ন্ত বেলা।


২০১২ সালের শুরুর দিকে ঘটনা। চোখের চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন শাজাহান সিরাজ। শঙ্কর নেত্রালয়ের ডাক্তার তার চোখের ছানি অপারেশন করাতে গিয়ে দেখেন- প্রচণ্ড কাশিতে ভুগছেন তিনি। পরে ডাক্তার তাকে কাশি কমিয়ে অপারেশন করার পরামর্শ দেন। এদিকে ওষুধ খাওয়ার পরও তার কাশি কমছিল না। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। ওই পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, তার ফুসফুসে টিউমার। ওই টিউমারটি বায়োপসি করানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসক। ওই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার পরিবারের ওপর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী সাবেক এই ছাত্রনেতার শরীরে বাসা বেঁধেছে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার। এরপর সেখান থেকেই তাকে নেয়া হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ।

সঙ্গে যান স্ত্রী মহিলা দলের সিনিয়র সহসভাপতি রাবেয়া সিরাজ ও পুত্র-কন্যা। মাউন্ট এলিজাবেথের একজন সার্জন সেখানকার একটি ক্যানসার বিশেষায়িত হাসপাতালে অপারেশন করার পরামর্শ দেন। সেখানেই তার ফুসফুসের টিউমার অপসারণ করা হয়। চার দফা দেয়া হয় কেমোথেরাপি। কিছুটা সুস্থ হলে দেশে ফিরে আসেন। এরপর থেকে গুলশানের বাসায় বিশ্রামে ছিলেন। রাজনৈতিক কিংবা পারিবারিক কোনো আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন না। তবে মাঝে-মধ্যে টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়ি যেতেন।

কিন্তু ২০১৪ সালের শেষের দিকে হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যান তিনি। কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দেন। এরপর তাকে দ্রুত ভর্তি করা হয় রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে। শারীরিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দেন। এরপর তাকে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার মাথায় টিউমার ধরা পড়ে। কিন্তু আগে থেকেই তার ডায়াবেটিস, কিডনিসহ নানা জটিল রোগ থাকায় মাথায় অস্ত্রোপচার করা যায়নি। পরে চিকিৎসকরা ওষুধের মাধ্যমে টিউমারটি অপসারণের পরামর্শ দেন। ওই চিকিৎসকের ওষুধের পাশাপাশি জাপানি কিছু হারবাল ওষুধ খাওয়ান। এরপর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন পর তার শারীরিক অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়ে। দ্রুত তাকে এ্যাপোলো হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এছাড়া খাবার তার খাদ্য নালীর পরিবর্তে কণ্ঠনালী দিয়ে ফুসফুসে ঢুকে যায়। তাই মুখের পরিবর্তে তার পেটে টিউব লাগিয়ে তরল খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এবং যতদিন তিনি বাঁচবেন ততদিন এভাবেই তাকে খাওয়াতে হবে বলে জানান তারা। এতে ভড়কে যান শাজাহান সিরাজের স্ত্রী। টিউব না লাগিয়েই তাকে বাসায় নিয়ে আসেন।

কিন্তু দুসপ্তাহ পর ফের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। আবার নেয়া হয় এ্যাপোলো হাসপাতালে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তার পেটে লাগানো হয় টিউব। এরপর থেকে মুখ দিয়ে কোনো খাবার খাননি। ওই টিউব দিয়ে তরল খাবার খাওয়ানো হয়। চার বছর ধরে অসুস্থ স্বামীর সেবা-শুশ্রূষা করছেন স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ। তিনি জানান, ফুসফুসের টিউমারটি অপসারণের পর অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মাথায় টিউমার ধরা পড়ার পর তিনি একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন। ভেঙে পড়ে তার স্বাস্থ্য। শুকিয়ে গায়ের চামড়া হাড়ের সঙ্গে লেগে গেছে। তিনি আরো জানান, দুবছর আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিকভাবে খাবার খেতে পারছেন না তার স্বামী। চিকিৎসকরা পেটে টিউব লাগিয়ে দিয়েছেন। দুই ঘণ্টা পরপর ওই টিউব দিয়ে তাকে তরল খাবার খাওয়ানো হয়।

এমনকি চাও টিউব দিয়ে খাওয়ানো হয়। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়েই সময় কাটান। রাতে ও দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমান। জেগে থাকলে টিভি দেখেন। দুজনের কাঁধে ভর করে বাথরুমে নিতে হয়। দুজন গৃহকর্মীসহ অন্তত চারজন লোক সার্বক্ষণিক তার দেখভালে নিয়োজিত। তিনি আরো জানান, আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিত কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দেন খুবই ক্ষীণ স্বরে। গত দুবছর ধরে কথা বলেন অনেকটা ইশারা-ইঙ্গিতে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠকের করুণ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেয়ার বিষয়ে আক্ষেপ করে রাবেয়া সিরাজ বলেন, এটা বলতে কষ্ট হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের সময় যার মাথার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছি পাকিস্তান সরকার, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দিল তাদের খোঁজ কেউ রাখেনি।

২০১৪ সালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করার পর বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক দেখতে এসেছিলেন। এরপর আর সরকারের পক্ষ থেকে কেউই কোনো খোঁজ নেয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে সিদ্ধেশ্বরী মহিলা কলেজের সাবেক এই ভিপি বলেন, তিনবার মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন শাজাহান সিরাজ অথচ নিজের নামে কোথাও কোনো কিছু করেননি। জোট সরকারের আমলে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর কলেজের শিক্ষকরা আবদার করেছিলেন- শাজাহান সিরাজের নামে কলেজের নামকরণ করার জন্য। এরপর সরকারের কাছে আবেদনও করা হয়। এমনকি  শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমি নিজে কয়েকবার গিয়েছি। তিনিও দিচ্ছি-দেব বলে ঘুরাচ্ছেন। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আর চাওয়ার কিছু নেই।


১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করা শাজাহান সিরাজ তিনবার মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর প্রথমে নৌ পরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে ফের চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে পাটমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ওয়ান-ইলেভেনে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বাইরে ছিলেন তিনি। দেশে ফিরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। অলিখিত অবসর নেন বিএনপির রাজনীতি থেকে।-এমজমিন

২৯ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে