রবিবার, ০৫ জুন, ২০১৬, ০৯:০৪:৩৮

ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো হে প্রভু : এসপি বাবুল আক্তার

ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো হে প্রভু : এসপি বাবুল আক্তার

ঢাকা : জঙ্গি দমনে সিদ্ধহস্ত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার পেয়েছেন একাধিক রাষ্ট্রীয় পদক। সাহসিকতায় পরিচয় দেয়া চৌকস এই পুলিশ কর্মকর্তা চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার থাকাকালে গত বছরের অক্টোবরে অসংখ্য অস্ত্র-গুলিসহ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন।

নগরের কর্ণফুলীর খোয়াজ নগর থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাটহাজারীর আমানবাজারে টানা অভিযান চালান তিনি।  খোয়াজ নগরে অভিযান চালানোর সময় জঙ্গিরা তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়লেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি।  ওই অভিযানেই চট্টগ্রামে জঙ্গিদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়।

এরপর থেকে বাবুল আক্তার নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও পিছু হটেননি।  পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একাধিক জেএমবি সদস্য ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের নেতৃত্ব দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। সম্প্রতি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় আসার পরই ঘটে বিপত্তি।

অদম্য এই সাহসী মানুষটির স্ত্রীকে খুন করে দুর্বৃত্তরা।  অথচ এর আগে তার পরিবারের সদস্যরা ব্যক্তিগত আলাপে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তার কথা প্রকাশ করেছিলেন।  

চট্টগ্রামের জিইজি মোড়ে যে বাসায় বাবুল আক্তার পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তার স্ত্রী তা বদল করার কথাও আশপাশের বাসিন্দাদের জানিয়েছিলেন।  কিন্তু সেই বাসা আর বদল করা হলো না মিতুর।  রোববার সকালে দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ দিতে হলো বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে।

স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ বাবুল আক্তার।  ঢাকায় বসে স্ত্রী হত্যার দুঃসংবাদ শুনে র‌্যাবের বিশেষ হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে আসেন তিনি।

হাসপাতালে প্রিয়তম স্ত্রীর নিথর মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই পুলিশ কর্মকর্তা।  সহকর্মী ও সাধারণ মানুষের অসম্ভব প্রিয় এ মানুষটিকে তখন কেউ সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পায়নি।  

অথচ গত বছর ৭ অক্টোবর পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের মিশন সফল করে বীরদর্পে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার।  তাতে পেশাগত কাজ করতে গিয়ে নানা বাধাবিপত্তির পাশাপাশি পরিবারকে সময় দিতে না পারার আক্ষেপও ছিল তার।

ফেসবুকে তার ওই সময়ের সেই আবেগঘন স্ট্যাটাসটি ছিল-

“কিশোর বয়সে পড়ার টেবিলে বসে চুরি করে শার্লক হোমস পড়তে পড়তে রহস্যের দুনিয়াতে হারিয়ে যেতাম।  ভাবতাম কত সহজেই শার্লক হোমস রহস্যের জট খুলে ফেলে। কিশোর পেরিয়ে যৌবনে এসেছি সে মেলা দিন। পুলিশে এসেছি তাও ১০ বছর পেরিয়ে গেল। এখন বুঝি শার্লক হোমস হওয়া কত কষ্টের, কত সাধনার। একটা জটিল রহস্যের জট উন্মোচন করা হিমালয় ডিঙ্গানোর চেয়ে কম নয়।

বায়োজিদ থানা এলাকায় গত মাসের ল্যাংটা ফকির ও তার খাদেম খুন হওয়ার পর থেকে সেই যে ঘুম হারাম হল। এরই মধ্যে আবার সদরঘাট থানাতে ঈদের ১ দিন আগে ঘটে গেল তিন খুন!! পুরো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ঘুম হারাম।

নানা সূত্র ধরে এগুতে এগুতে টানা পরিশ্রম করতে হয়েছে। রাতে বাসায় না ফিরে, সন্তানদেরকে নানা কথায় ভুলিয়ে নগরে, বন্দরে, গ্রামে, পাহাড়ে, অলি গলিতে হেঁটে, কাদাপানি মাড়িয়ে সবশেষ দেখা মিলল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের। আটক হল ৫ জঙ্গি। উদ্ধার হলো ৯টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১২০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি ও জিহাদি বই, জঙ্গিদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল।

অল্পের জন্য জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড হতে বেঁচে গেলাম আমি, আমার টিমের পাঁচ সদস্য এবং বাড়িওয়ালার স্ত্রী। পেলাম নতুন জীবন, শুকরিয়া স্রষ্টার।

আটক জঙ্গিরা স্বীকার করলো উক্ত পাঁচ হত্যাকাণ্ডের কথা। তাদের কথামত উদ্ধার হলো ন্যাংটা ফকির ও তার খাদেম হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা ও রক্তমাখা কাপড় চোপড় ও বাইসাইকেল। ছিনতাইয়ের সময় (ত্রিপল মার্ডার) ব্যবহৃত মোটরসাইকেল।

শেষ হলো একটি মাসের পরিশ্রম, উন্মেচিত হলো জমাট বাঁধা রহস্য, যে রহস্যের ছিল না কোনো কূল কিনারা ( ক্লু-লেস ক্রাইম)। যে রহস্যের শুরু হয়েছিল বায়োজিদে, সে রহস্য শত মাঠ ঘাট, শহর, বন্দর, পাহাড়, নদী পার হয়ে এসে শেষ হলো কর্ণফুলির খোয়াজনগরে।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের অভিযান শেষে ক্লান্তি এসে ভর করত কিনা জানি না তবে আমার মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে। তারপরও সবসময় বলি  “ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো হে প্রভু”।’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পুলিশের ২৪তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন।  সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে তার প্রথম কর্মজীবন শুরু হয় র‌্যাব-২ এ।

২০০৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কোতয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার পদে যোগ দেন।  পরবর্তীতে তিনি জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগ দেন।  দুর্ধর্ষ ক্যাডারবাহিনী দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আলোচনায় আসেন তিনি।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার একটি দুর্ধুর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনীকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে আলোচনায় আসেন বাবুল আক্তার।  হাটহাজারী সার্কেলে সাফল্যজনক ভূমিকা রেখে পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে দায়িত্ব পালন করে।

এ জেলায় তিনি অপরাধ দমনে প্রসংশনীয় ভূমিকা রেখে পুলিশ বাহিনীর সুনাম বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন।
পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার থেকে বদলি হয়ে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) পদে দায়িত্ব পালন করেন।

পরে একই সালের ১৪ জুলাই সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদান করেন তিনি।  মিশনে এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত দেড় মাস আগে বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর ও দক্ষিণ জোনে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে যোগ দেন।  সদ্য পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হিসেবে ঢাকায় আসেন তিনি।
৫ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে