সোমবার, ০৬ জুন, ২০১৬, ১২:৩৬:২২

রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হলেও, সাংগঠনিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বিএনপি

রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হলেও, সাংগঠনিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বিএনপি

কাফি কামাল: দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো সম্পন্ন হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত অংশ নেয় বিএনপি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে চরম প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে ধানের শীষের প্রার্থীদের। ৬ ধাপে অনুষ্ঠিত প্রায় সাড়ে তিন হাজার ইউপির মধ্যে পাঁচ শতাধিক ইউপিতে প্রার্থীই ছিল না বিএনপির। সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভয়ভীতি ও প্রশাসনের হয়রানির কারণে কিছু ইউপিতে প্রার্থীই দিতে পারেনি দলটি। আবার তুচ্ছ অজুহাতে এবং প্রস্তাবক-সমর্থকদের সমর্থন প্রত্যাহার করানোর মাধ্যমে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে অনেক ইউপিতে। নতুন করে হাজারো মামলায় আসামি হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মী। দ্বিতীয় ধাপের পর বর্জনের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যুক্ত থেকেছে বিএনপি। শেষ পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিনশ’র মতো ইউপিতে বিজয়ী হয়েছে ধানের শীষের প্রার্থী।

এবারের ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের লাভ-ক্ষতি নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে দলটির সিনিয়র নেতারা এ নির্বাচনকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা বলেছেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দারুণভাবে লাভবান হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। সব সময় ফলাফলের মাধ্যমে সাফল্যের বিচার হয় না। এ নির্বাচনের ফলাফল দখলের মাধ্যমে বিএনপির আন্দোলনের দাবিকে আরও জোরালো করেছে সরকারই। যা বিএনপির প্রতি সাধারণ  মানুষের সমর্থন বাড়ানোর পাশাপাশি আরও পরিষ্কার করেছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্রের শিক্ষা। আমাদের দল সেটা বিশ্বাস করে বলেই আমরা ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু এবারের নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থেই নির্বাচন বলা যাবে না। সরকারের নির্দেশে প্রশাসনের পক্ষপাত দুষ্টতা, নির্বাচন কমিশনের আজ্ঞাবহ ভূমিকা ও সরকারদলীয় প্রার্থীদের নৈরাজ্য, ভোট লুটপাট ও অনিয়মের কারণে এটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবারের ইউপি নির্বাচন দেশের মানুষকে হত্যা শিখিয়েছে। গ্রাম-বাংলাকে রক্তে রঞ্জিত করেছে। সার্বিকভাবে যে সহিংসতা হয়েছে তার কোনো তুলনা হয় না। এ নির্বাচন দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। মাহবুব বলেন, ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপির লাভ-ক্ষতি দুটোই হয়েছে। তবে নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত করে সেটা প্রমাণ হয়েছে। দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনে যে ব্যর্থ, অযোগ্য ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


অন্যদিকে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতে সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বিএনপি। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতারণা ও নির্বাচন কমিশনের ন্যক্কারজনক ভূমিকায় প্রমাণ হয়েছে এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ সরকার ও কমিশনের অধীনে জনগণ ভোট দিতে পারবে না। এ বিষয়ে একটি কমন সেন্টিমেন্ট (সাধারণ মনোভাব) সব মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সরকার কি কি ধরনের অপকর্ম করতে পারে তার অনেকটাই প্রকাশ ঘটেছে। রাজনৈতিকভাবে বিএনপির এটুকুই লাভ। গয়েশ্বর রায় বলেন, সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে লাভবান হয় যে কোনো রাজনৈতিক দল। নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ে এবং সম্পর্কের উন্নতি হয়। কর্মীরা সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে সমর্থনকে মজবুত করেন। কিন্তু এবার হয়েছে উল্টো। বিএনপি নেতাকর্মীরা সংঘটিত হতে পারেনি। মামলার ভারে আগে থেকেই বিপর্যস্ত নেতাকর্মীরা হাজারখানেক নতুন মামলার আসামি হয়েছেন।


এবারের ইউপি নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথকে আরও পরিষ্কার করেছে বলে মনে করেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। নির্বাচন বিশেষ করে ইউপি নির্বাচন গ্রামগঞ্জের মানুষের একটি আনন্দের উপলক্ষ। আমরা গ্রামগঞ্জের মানুষকে সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। এ ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র যাতে আরও শক্তিশালী হয় সেটা বিবেচনা করেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন হলো কই? নির্বাচন মানে তো প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, জনগণ ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে। যে বেশি ভোট পাবে সে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। কিন্তু এ সরকার নিজেরা যেভাবে ক্ষমতায় এসেছে ইউপিতে সেভাবে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী দেখিয়েছে। জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

নজরুল ইসলাম খান বলেন, এবারের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিরত রাখা হয়েছে। যারা ভয়কে জয় করে মনোনয়ন দাখিল করেছে তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে। প্রস্তাবক সমর্থকদের চাপ দিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করা হয়েছে। শেষপর্যন্ত যারা টিকে ছিল তাদের প্রচারণা চালাতে দেয়া হয়নি। নির্বাচনের আগের রাতে জালভোট দিয়ে বাক্স ভরা হয়েছে। ভোটের দিন সকালেই এজেন্টদের বের করে দিয়ে প্রকাশ্যে সিল মেরে সন্ধ্যায় সরকার দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী দেখানো হয়েছে। যেখানে বাধা দেয়া হয়েছে সেখানে ভাঙচুর, হামলা ও খুন-খারাবি করা হয়েছে। তাই এটাকে তো নির্বাচন বলা চলে না। বিএনপি স্থায়ী কমিটির এ সদস্য আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি এতে করে গ্রাম পর্যায়েও সরকারের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে এবং তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে কেন আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। ফলে নির্দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচন ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমাদের যে আন্দোলন তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়বে। শেষ পর্যন্ত একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথ আরও পরিষ্কার হয়েছে।


ইউপি নির্বাচন বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ানোর পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক ভিতকে মজবুত করেছে বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের পক্ষে ছিল না বিএনপি। আমরা প্রথম থেকেই এটার প্রতিবাদ করেছি। যেসব যুক্তিতে বিএনপি প্রতিবাদ করেছিল শেষপর্যন্ত সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষপাত ও নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীরা জোর জুলুম ও অনিয়মের মাধ্যমে ভোট ডাকাতি করেছে। বেশির ভাগ ইউপি চেয়ারম্যান পদেই তারা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। এর মাধ্যমে দৃশ্যত সরকার লাভবান হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আখেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারই। সারা দেশের মানুষের কাছে সরকারের নগ্নরূপ প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না বলে বিএনপির যে দাবি তা সরকারই প্রতিষ্ঠিত করেছে। যা বিএনপির দাবিকে সুসংহত করেছে।

রিজভী বলেন, আমরা প্রথম থেকেই জানতাম সরকার জোরজবরদস্তি করে ফলাফল ছিনিয়ে নেবে। নির্বাচনে সহিংসতা হবে। কিন্তু তারপরও নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্মান জানিয়ে আমরা অংশ নিয়েছি। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের নেতাকর্মীরা হামলার শিকার ও নতুন মামলার শিকার হলেও সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বিএনপি। বরং দেশের মানুষের কাছে বিএনপির প্রতি নতুন করে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছে, সমর্থন বেড়েছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার আমাদের রাজনীতি করা বা সংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ দিচ্ছে না। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কর্মীদের সক্রিয় করা ও সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকার ন্যূনতম সুযোগটি নিতে পেরেছে বিএনপি।-সুত্র: মানবজমিন

৬ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে