বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০১৬, ০৯:৫৪:৫৪

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে ব্রিটেনের পার্লামেন্টের ওয়েস্টমিনিস্টার হলে। ব্রিটিশ এমপি সাইমন ড্যানচুক এ সংক্রান্ত একটি মোশন উত্থাপন করেন। এ নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি পৃরুপা হক, প্যানেল অব চেয়ার্স স্যার অ্যালান মিল ও বৃটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যার।

বিতর্কের প্রারম্ভে এমপি ড্যানচুক বিতর্কের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে ১৯৭১ সালে দেশটির স্বাধীনতার কিছুটা সমপর্ক আছে বটে। কিন্তু এ পরিস্থিতি মূলত ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি মারাত্মকভাবে ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের কারণে সৃষ্ট। ওই নির্বাচনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল কারণ আওয়ামী লীগ সরকার ফলাফল অপব্যবহার (ম্যানিপুলেট) করছিল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সৃষ্টির কথা বিবেচনা করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বিরোধী দলের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অবশ্যই, বিরোধী দলের জন্য সন্তুষ্টচিত্তে এ নির্বাচনে অংশ নেয়াটা সরকার অসম্ভব করে তোলে। এ কারণেই বিরোধী দল ওই নির্বাচন বয়কট করে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যেখানে এখন নতুন সাধারণ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, আমরা দেখছি যে ওই আওয়ামী লীগ সরকারই ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে বৈধ উপায়ে তারা এ নির্বাচনে জিতবে না।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্কে আমি কথা বলবো প্রথমত, ওই ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের প্রভাব; দ্বিতীয়ত, এখন কী ঘটছে, বিশেষ করে যেসব নৃশংসতা দেশটিতে ঘটেছে; তৃতীয়ত, বাংলাদেশে পরবর্তীতে যা ঘটবে তা নিয়ে আমাদের কী ধারণা করা উচিত; চতুর্থত, এসব কেন যুক্তরাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; এবং পঞ্চমত, ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে সরকার, তার ব্যাপারে আমার প্রত্যাশা।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে- এ ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ মিলছে। কয়েক সপ্তাহ আগে আমি দেশটিতে ছিলাম। সেখানে বিশ্বাসযোগ্য কিছু বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা বলি। আমি জেনেছি, দেশটির স্থানীয় নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই শাসক দলের জন্য বাক্সে ব্যালট পেপার পুরে রাখা হয়। বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ না নিতে বা প্রচারণা না চালাতে বলা হয়। ওই সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের রাজনীতিকরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর বাইরের ইস্যু রয়েছে দেশটির মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বাধা ও মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুপা হক ঢাকায় অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন সমপর্কে কথা বলেন। এ পর্যায়ে আলোচনায় অংশ নেন কনজারভেটিভ দলীয় এমপি জন হাওয়েল। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে বেশ ক’বার গেছি, একবার ছিল নির্বাচনের মৌসুম। এবং নির্বাচনের ইস্যু সেখানে সবসময়ই খুবই সহিংস বিষয়। কিন্তু এই নির্বাচন (৫ই জানুয়ারির) কেন আগের নির্বাচনের চেয়ে আলাদা?’

জবাবে এমপি ড্যানচুক নির্বাচনী সহিংসতার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। তবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা এখন অসহ্য পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমি এমন কিছু নিয়ে কথা বলবো যা প্রমাণ করে, পরিস্থিতি গৃহ-অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। এটির দিকে নজর দিতে হবে। আপনি যখন দেশটিতে ছিলেন, তার চেয়ে এখন উত্তেজনা সম্ভবত অনেক বেশি।’

সাইমন ড্যানচুক আরও বলেন, ‘রিপোর্টার্স উইদাউথ বর্ডার ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৪তম স্থানে রেখেছে। কিন্তু সরকারের কাছে পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ মনে হয়নি। এ কারণে ৪ঠা মে বাংলাদেশ সরকার একটি মিডিয়া মনিটরিং সেন্টার গঠনের কথা ঘোষণা করেছে। প্রিন্ট ও টেলিভিশনের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাবার্তা চলছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে কেউ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবাকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের অধীনে কারও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দেয়ার অভিযোগে কাউকে সাজা দেয়া সম্ভব। লিবারেশন ওয়্যার ডিনায়াল ক্রাইমস অ্যাক্ট নামে আরেকটি আইনেও একই ধরনের ধারা রয়েছে।’

ড্যানচুক ধারাবাহিক ব্লগার হত্যা ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর দায় স্বীকারের দরুন বিচারহীনতার পরিবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সৃষ্ট ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থার বরাতে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন।

তিনি মন্তব্য করেন, বিচারবিভাগও পক্ষপাতদুষ্ট ও একে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের প্রসঙ্গের পাশাপাশি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো বিরোধী নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য করতে সরকার বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে অভিযোগও করেন।

তার মন্তব্য, পরবর্তী নির্বাচন হবে আরও ত্রুটিপূর্ণ। বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চলায় শূন্যস্থান দখলে নিতে চায় উগ্রপন্থিরা। তিনি একপর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সম্ভবত গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এজন্য তিনি বৃটিশ সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে তিনি বাংলাদেশের সরকারের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ, রাজনীতিকৃত সংস্থায় সাহায্য বন্ধ, নিরাপত্তা সংস্থাকে যুক্তরাজ্যের দেয়া সমরাস্ত্র ও সরঞ্জামের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ এবং বাংলাদেশের ওপর অবরোধ আরোপের কথা বিবেচনা করতে আহ্বান জানান।

নিজের বক্তব্যের প্রথমেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যার এমপি সাইমন ড্যানচুককে গুরুত্বপূর্ণ এ বিতর্ক নিশ্চিত করায় অভিনন্দন জানান। তিনি রুপা হককেও ধন্যবাদ জানান। হুগো সয়্যার বলেন, ‘গত বছরের জুনে, এখানেই নৃশংস ব্লগার হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক হয়। এরপর অনেকের ওপর হামলা হয়েছে। অনেক হামলার দায় দায়েশ ও আল- কায়েদার সঙ্গে সমপর্কিত গ্রুপ স্বীকার করে নিয়েছে।

এছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপরও চাপ আছে, আছে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের বিরোধী কণ্ঠের ওপর।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্রের পরিণত ক্রিয়ার সত্যিকার লক্ষণ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দলেরই এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের সব পক্ষের সঙ্গে ইউকে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকা অব্যাহত রাখবে। আন্তর্জাতিক আংশীদারদের সঙ্গে নিয়েও। ডেমোক্রেটিক চ্যালেঞ্জ ও বিতর্কের স্থান সঙ্কুচিত হওয়ায় চরমপন্থি ধ্যান-ধারণার প্রসার ঘটতে পারে। আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, দেশটির ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড এখন খুবই সাধারণ ঘটনাবলীতে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ২৭শে মে টোকিওতে এ নিয়ে কথা বলেছেন।

তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এসব চরমপন্থি হামলা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা খর্ব করতে পারে। ২৪শে মে বাংলাদেশী হাইকমিশনারের কাছে আমি এ উদ্বেগের কথা তুলেছি। ঢাকায় আমাদের হাইকমিশনার এসব ইস্যুতে নিয়মিত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলছেন।’

ব্রিটিশ এ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশের দ্বারা সন্দেহজনক ক্রসফায়ার ও গণগ্রেপ্তার বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর বিশ্বাস কমিয়ে দেয়। তদন্ত অবশ্যই হতে হবে স্বচ্ছতা ও পক্ষপাতহীনতার সঙ্গে। এছাড়া এসব আক্রমণের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতার মূল কারণ উদঘাটনও জরুরি। আমরা বাংলাদেশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার আহ্বান জানাই। সরকারকে অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবন ধারণকারীদের সুরক্ষিত করতে হবে। ভিকটিমদেরকে দায়ী করা যাবে না।’ হুগো সয়্যারের বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে মানবাধিকার ও  সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকির বিষয়গুলো। তিনি এসব নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এসব ইস্যুতে যোগাযোগ বজায়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। -এমজমিন
৩০ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে