ড. আকবর আলি খান : আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। আগামী নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এতে মতবিরোধ অনেক কমে আসবে। আগামীতে নির্বাচন যদি প্রধানমন্ত্রীর অধীনেও করা হয়, তাহলে সেই সময়ের জন্য নতুন কার্যবিধি প্রণয়ন করলেই হবে। এতে অনেক সমস্যাই দূর করা সম্ভব। সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে হবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বদলে মন্ত্রিসভাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে।
একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে সব দলের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা থাকা উচিত। তাহলেই সেটা অনেকাংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো কাজ করবে। মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ কার্যালয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সাবেক এই অর্থসচিব চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এসব খোলামেলা কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমি যেটা বলছি, এটাই যে একমাত্র ব্যবস্থা তা নয়। এ নিয়ে আরও বিকল্প আলোচনা হতে পারে। আলোচনায় বসলে বিভিন্ন পদ্ধতি বের হবে। কারণ বাংলাদেশে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা অতীতে ঘটেছে। বাংলাদেশে আমরা কখনো বেশিদিন নিরাশার মধ্যে থাকিনি। আমার ধারণা, যদিও মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে অনেক কিছুর সমস্যার সমাধান নেই কিন্তু বাংলাদেশের সৃজনশীল মানুষ আজকের যে সমস্যা তা নিরসন করতে সক্ষম হবে।
তার মতে, 'সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলে ওই মন্ত্রিসভার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ওই সরকারে যেসব দল অংশগ্রহণ করবে, প্রত্যেক দলকে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। এতে প্রধানমন্ত্রী অপরিবর্তিত থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না। এটা কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে হবে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আকবর আলি খান বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হলে অতীতে বাংলাদেশের সংঘর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে যেতে হবে। দেশের রাজনীতি অতীতেও সংঘর্ষের মধ্যে ছিল। বর্তমানেও সংঘর্ষ-হানাহানির রাজনীতি রয়েছে। যদিও এর প্রকাশ বাইরে বেশি দেখা যাচ্ছে না। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতেও যে সংঘর্ষ থাকবে-এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
উত্তরণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা থেকে উত্তরণে সহজ কোনো উপায় নেই। এ জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য যেমন জনসাধারণের পক্ষ থেকে উদ্যোগ আসতে হবে, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও উদ্যোগ আসতে হবে। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। সে জন্য ভবিষ্যতের রাজনীতিতে যে সংঘর্ষ হবে না-তা আশা করা কষ্টকর।
ড. আকবর আলি খান বলেন, 'প্রত্যেক দলই তার রাজনৈতিক অবস্থানে অনড়। তবে এটা মনে রাখতে হবে, গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এটা সংবিধানের মূল চেতনার বিরোধী। গণতন্ত্রে সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়। এত আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সব ম্লান করে দিয়েছে। এ জন্য সবার অংশগ্রহণে যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে-দেশের জন্য ততই ভালো।
দেশে চলমান অস্থিরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হঠাৎ করেই অস্থিরতা বা খুনোখুনি এটা ঠিক নয়। সাধারণত আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি হয়। এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি যেখানে চলে সেখানেই সাধারণত এ ধরনের হানাহানি দেখা যায়। এটা আগের সরকারের আমলেও ছিল। তবে সেটা হয়তো কম ছিল, এখন হয়তো বেশি। বিএনপির আমলেও এ সমস্যা ছিল। তবে এত তীব্র ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাই। আমরা চাই দেশে সুশৃঙ্খলভাবে সবকিছু পরিচালিত হোক।
নতুন বেতন কাঠামোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, 'এটা প্রয়োজন ছিল। কারণ দ্রবমূল্য বৃদ্ধির ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয় কমে গেছে। শুধু বেতন বাড়ালেই হবে না, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সেই উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত না করলে অর্থের খচর বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। আর বড় সমস্যা হলো-এ ধরনের বেতন বাড়ানোর ফলে পেনশন বা অবসর ভাতার ব্যয় বেড়ে যাবে। যদি এ ধরনের ব্যয় বেড়ে যায়, সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। পেনশন ও অবসর ভাতার বিষয়েও নজর দেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আর এ ধরনের বেতন ভাতা বৃদ্ধিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসল সমস্যার সমাধান হবে না। যারা সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ বেতন পান, তাদের উল্লেখযোগ্যহারে বেতন বাড়বে। কিন্তু সবারই ৭০ বা ৮০ ভাগ বেতন বৃদ্ধি হবে না। তাদের যখন নতুন স্কেলে বেতন পুনর্নির্ধারণ করা হবে-তখন দেখা যায় যে, এত লাভ হয় না। এর ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্যা থেকেই যায়।
এতে মধ্যম শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নতুন কোনো ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে কি না- জানতে চাইলে সাবেক অর্থসচিব বলেন, এটা নির্ভর করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বেতন কাঠামো স্পষ্ট নয়। এর সঙ্গে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও বেতন স্কেলের দাবি আছে। বিচার বিভাগের বেতন কাঠামো নিয়েও সরকারের সঙ্গে মতদ্বৈততা আছে। তাই এখনো বেতন কাঠামো নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাবে না।
এগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলেই বোঝা যাবে, বেতন প্রক্রিয়ায় নতুন কোনো মেরুকরণ সৃষ্টি হয় কি না। দ্রব্যমূলের বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। কিন্তু সরকারের রাজস্ব আদায় যদি না বাড়ে তাহলে এর প্রভাব বাজারে পড়বে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে না কমবে-তাও নির্ভর করবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর।
সরকারের অনিয়মের প্রতিবাদে দেশে প্রকৃত কোনো বিরোধী দল আছে কি না-জানতে চাইলে ড. আকবর আলি খান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব বিরোধী দল আছে, তারা নানা অসুবিধার মধ্যে কাজ করছে। তবে বিরোধী দল থাকলেই আন্দোলন হবে, এটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটা নির্ভর করে দেশের পরিস্থিতির ওপর। সুতরাং দেশের পরিস্থিতি কী হয়, তার ওপর নির্ভর করবে, দেশে কোনো আন্দোলন হবে কি না। তবে বাংলাদেশে নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তি হয়তো হবে।
তবে এ মুহূর্তে কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণ হিসেবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, দেশের মানুষ মনে করে, সব অপরাধের বিচার হয় না। অপরাধীরা শাস্তি পায় না। তারা শাস্তি না পেলে অপরাধে আরও উৎসাহিত হয়। আইনশৃঙ্খলাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে অপরাধীদের ধরতে হবে। তাদের বিচার করতে হবে। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচারকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।-বিডিপ্রতিদিন
৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে