দীপন নন্দী: বাড়ির চারপাশে সুনসান নীরবতা। বাড়ির ভেতরে যারা বসবাস করছেন, তারা আকস্মিক বিচ্ছেদ বেদনায় হতবিহ্বল। অন্তঃপুরের বাতাস প্রিয়জন হারানোর দীর্ঘশ্বাসে ভারি। এক রাতের প্রলয়ে স্বামী হারিয়ে স্ত্রীর দু'চোখে বোবা দৃষ্টি। নির্বাক তাকিয়ে আছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায়। বাবার মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন মেয়ের হৃদয়জুড়ে সব হারানোর হাহাকার। কেবল অবুঝ ছেলের মনে বাবার মৃত্যু এখনও ছায়া ফেলতে পারেনি। কিছু না বুঝে কখনও কখনও উচ্ছল হয়ে উঠছে সে। একের পর এক বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন আসছেন। তাদের সমবেদনা জানিয়ে নীরবে বিদায় নিচ্ছেন। কিন্তু যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের কোনো সাত্ত্বনার ভাষা যেন স্পর্শ করছে না। এই পরিবারের যিনি ছিলেন প্রধান, তিনি নিজের মূল্যবান প্রাণ উৎসর্গ করেছেন দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্য।
কিছু নিরপরাধ মানুষকে সশস্ত্র জঙ্গিদের তপ্ত বুলেট থেকে রক্ষার জন্য নিজে লড়েছেন সর্বশক্তি দিয়ে। গুলশানের কূটনৈতিকপাড়ায় হলি আর্টিসান বেকারি রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শুক্রবার রাতে নিহত হয়েছেন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান। তার পরিবারের সদস্যদের কাছে এই আত্মোৎসর্গ এখন একমাত্র সান্ত্বনা, ভরসা এবং প্রাপ্তির জায়গা। মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ের ৩/৪ নম্বর কাজী মোশাররফ হোসেন টাওয়ারের ১১ তলার 'এ' নম্বর ফ্ল্যাটে স্ত্রী রেমকিম খান, মেয়ে সামান্থা খান ও ছেলে সিয়াম খানকে নিয়ে সুখের সাজানো সংসার ছিল ওসি সালাহউদ্দিন খানের। গতকাল শনিবার সকালে সেখানে প্রবেশ করতে গেলে নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দেন।
তারা জানান, 'ম্যাডাম (সালাহউদ্দিন খানের স্ত্রী) কাউকে ভেতরে যেতে নিষেধ করেছেন।' ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলেও তারা জানান যে, গত দেড় বছর ধরে এ বাড়িতে থাকছে সালাহউদ্দিন খানের পরিবার। সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল পুরো পরিবারটির। বাড়ির পাশে গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্রী সামান্থা আর প্রথম শ্রেণীতে পড়ে সিয়াম। সময় পেলেই দুষ্টুমি করে অবসর সময় পার করতেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সালাহউদ্দিনের মরদেহ নিতে আসেন তার বড় ভাই রাজীউদ্দিন খান। তিনি জানান- সাত ভাই, চার বোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন সালাহউদ্দিন। ছোটবেলা থেকেই সাহসী সালাহউদ্দিন সবসময়ই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতেন। সে কারণেই তিনি পুলিশে যোগ দেন।
তিনি বলেন, তার ভাই সব সময় সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। সে কাজ করতে গিয়েই তিনি শহীদ হয়েছেন। সবাই যেন তার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করেন। শুক্রবার রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজীউদ্দিন। তিনি জানান, তাকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা ছিল তার ভাইয়ের। সে রাতে তার গাড়ি আসতে দেরি হওয়ায় তিনি (রাজীউদ্দিন) তারাবির নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষ করে টেলিভিশনের পর্দায় দেখেন তাদের আদরের প্রিয় ভাইকে চিরতরে হারিয়েছেন ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা করেছিলেন। কিন্তু ঈদের ছুটি নেননি। বলতেন, বনানী ভিআইপি এলাকা। এখানকার নিরাপত্তা বেশি কঠোর। এ কারণে ঈদে তিনি ছুটি নেবেন না। হাসপাতালে কথা হলো সালাহউদ্দিনের বাল্যবন্ধু জাহাঙ্গীর কবীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, বুকের মধ্যে একটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। ক্লাস ওয়ান থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। শুক্রবার মোতালিব প্লাজায় থাকার সময় গুলশানের ঘটনাটি জানতে পেরে সালাহউদ্দিনের আত্মীয় মিরপুর থানার ওসিকে ফোন দেন তিনি। কিন্তু ফোন না ধরায় টেলিভিশনের পর্দায় খবর শুনে জানতে পারেন প্রিয় বন্ধুর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা।
ঢামেকে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সালাহউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। সেখানে জানাজার আগে দেখা যায় মরহুমের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। গাড়ির ভেতরে শোকাহত রেমকিম বারবার চোখ মুছছিলেন। অনেকেই তাকে সান্ত্বনা জানাতে এগিয়ে যান। বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল সামনে থাকা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। যেখানে চিরঘুমে শায়িত তার প্রিয়তম স্বামী। কথা বলতে রাজি হলেন না তিনি। বাবার মৃত্যুতে মেয়ে সামান্থার নির্বাক চাহনি আর্দ্র করে তুলেছিল সেখানকার পরিবেশ। গাড়ির সামনের সিটে বসে একদৃষ্টিতে সামান্থা তাকিয়ে ছিল অ্যাম্বুলেন্সের দিকে।
সেখানে কথা হলো সালাহউদ্দিনের ব্যাচমেটের স্ত্রী ফাতেমা জান্নাত আইরিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আমাদের। কসোভোর মিশনে তিনি আর আমার স্বামী একসঙ্গে ছিলেন। সেখানে পারিবারিক বন্ধন গড়ে ওঠে আমাদের মধ্যে। সালাহউদ্দিন ভাই তার মেয়েকে এতটা ভালোবাসতেন যে, না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কোনো মেয়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা যে এতটা তীব্র হয়, তা সালাহউদ্দিন ভাইকে না দেখলে কোনোদিন বুঝতে পারতাম না। রাজারবাগ পুলিশ লাইন জামে মসজিদ ও শহীদ এসআই শিরু মিয়া মিলনায়তনে সালাহউদ্দিন খান ও রবিউল করিমের দুই দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যরা।
জানাজা শেষে সালাহউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার মোহাম্মদপুরের বাসভবনে। তার মরদেহ বাসায় পৌছাতেই আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে চারপাশের পরিবেশ। ২০ মিনিট রাখার পর সালাহউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন বীর এই পুলিশ কর্মকর্তা। সালাহউদ্দিন খান ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জ সদর থানার ব্যাংকপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে এসআই পদে তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। ২০০৭ সালে তিনি পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। ইতিপূর্বে তিনি এসবি, সিআইডি এবং ডিএমপির কোতোয়ালি ও মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।-সমকাল
৩ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ