রবিবার, ০৩ জুলাই, ২০১৬, ১০:১১:৪২

অপারেশন থান্ডারবোল্ট সফল যেভাবে

অপারেশন থান্ডারবোল্ট সফল যেভাবে

তোহুর আমদ: অপারেশন থান্ডারবোল্ট। বাংলায় যার ভাবার্থ বজ্রপাত বা ঝড়ো হাওয়া। জঙ্গি আক্রমণের শিকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে জিম্মি উদ্ধারে বৈদ্যুতিক ক্ষিপ্রতায় এই অপারেশন চালায় যৌথবাহিনী। শ্বাসরুদ্ধকর এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। যাদের প্রতিটি সদস্য দুঃসাহসী, উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত।   শুক্রবার রাত পৌনে ৮টায় সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে যে জিম্মি সংকটের সৃষ্টি করে তা শেষ হয় শনিবার সকাল ৯টার কিছু পর। সংকট সমাধানে অভিযানে নামতে বাধ্য হয় সেনা ও নৌ বাহিনীর বিশেষ কমান্ডো দল। তাদের সঙ্গে এই যৌথবাহিনীতে ছিল র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি। রুদ্ধশ্বাস অভিযানের মধ্য দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে দেশী-বিদেশী ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

সূত্র জানায়, অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালিত হয় মূলত দুটি ভাগে। এর প্রথম ভাগে ছিল নিরাপদে জিম্মিদের উদ্ধার পরিকল্পনা কৌশল। এরপর দ্বিতীয় ধাপে বন্দুকধারী জঙ্গিদের পাকড়াও করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অভিযান রক্তপাতহীনভাবে সমাপ্ত হয়নি। কারণ আততায়ীরা রেস্টুরেন্টে ঢোকার মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই বেশিরভাগ বিদেশী নাগরিককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। গুলির পর নৃশংসতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে নিহতদের প্রত্যেককে জবাই করে ঘৃণ্য এই হামলার কুশীলবরা।

আইনশৃংখলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হওয়া এই অপারেশনের স্থায়িত্ব ছিল ১৩ মিনিট। এরপর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা আসে। দুঃসাহসিক এই অপারেশন প্রযুক্তির সহায়তায় নিজ নিজ কার্যালয়ে বসে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা। অভিযানের পুরোটা সময় বেতার বার্তায় সংযুক্ত ছিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এই জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় আর্মি প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা প্রথমবারের মতো সরাসরি অংশ নিয়ে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

শুক্রবার রাত তখন আনুমানিক পৌনে ৯টা। এশার আজান শেষে সবাই তারাবির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠিক এমন সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গুলিবিনিময় চলছে। কেউ কেউ বলছিলেন, পুলিশসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছে। কিন্তু খবরের সত্যতা নিশ্চিত হতে না পেরে সবাই এক ধরনের দ্বিধা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় পার করতে থাকেন।
ওদিকে ইফতারের পর অন্যদিনের মতোই রাজধানীর গুলশান-২-এর কূটনৈতিকপাড়া সংলগ্ন ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান নামের আক্রান্ত রেস্টুরেন্টে তখন বেশ কিছু বিদেশী নাগরিকের উপস্থিতিও ছিল। স্প্যানিশ এই রেস্টুরেন্টটি ছিল মূলত বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের নিরাপদ আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। যেখানে ওই সময় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীও ছিলেন।

সূত্র জানায়, রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার প্রথম খবরটি আসে গুলশান পুলিশের বেতার বার্তায়। গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মুসতাক আহমেদ বেতার বার্তার মাধ্যমে তার এলাকার সব ফোর্সকে ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিক ব্রিফ করেন। পরিস্থিতি মোকাবেলার নির্দেশনাও দেন তিনি। খবর পেয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যেতে শুরু করেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা। একইসঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় র‌্যাবের বেশ কয়েকটি টিম। জঙ্গিরা পুলিশ ও র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করে। তারা মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়।   পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলিবিদ্ধি হন বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলামসহ ১৩ জন পুলিশ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে হাসপাতালে নেয়ার পর ওসি সালাউদ্দিন খান ও সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে আতংক নেমে আসে। রাত ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে র‌্যাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

তারা প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু অস্ত্রধারী জঙ্গিরা এতে সাড়া দেয়নি। এরপর র‌্যাব কর্মকর্তারা রেস্টুরেন্টের আশপাশে কৌশলগত অবস্থান নিতে শুরু করেন। এ পর্যায়ে পুলিশপ্রধান একেএম শহীদুল হকসহ একে একে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে হাজির হন। ছুটে আসেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরাও। জিম্মিদের উদ্ধারে মোতায়েন করা হয় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াত (স্পেশাল উইপন অ্যান্ড ট্যাকটিকস)। পুলিশ ও র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, ডগ স্কোয়াড, সাঁজোয়া যান বা এপিসি মোতায়েন করা হয়। গ্যাস মাস্ক, নাইট ভিশন ক্যামেরা ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে র‌্যাব। একই সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী রোবট ও উচ্চ প্রযুক্তির যোগাযোগ সামগ্রী স্থাপন করা হয়।

কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে পুলিশ ও র‌্যাবের তৎপরতা আঁচ করতে পেরে ভবনের বাইরে একের পর এক শক্তিশালী গ্রেনেড ছুড়ে মারে জঙ্গিরা। এতে র‌্যাব ও পুলিশের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা শরীরে স্প্রিন্টার বিদ্ধ হন। তাদের দ্রুত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ পর্যায়ে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে একটি যৌথ অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু জঙ্গিদের এলোপাতাড়ি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলির মুখে এ পরিকল্পনা স্থগিত করতে বাধ্য হন নীতিনির্ধারকরা। অবশ্য এর আগে র‌্যাব ও পুলিশের সহায়তায় ভবনের ভেতর থেকে অন্তত ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। কিন্তু রাত যতই গড়াতে থাকে পরিস্থিতি ততই জটিল আকার ধারণ করে। এমনকি ভবনের ভেতরে আটকে পড়া জিম্মিদের জীবিত উদ্ধারের আশাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। এ পর্যায়ে করণীয় নির্ধারণে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে মধ্যরাতেই বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের ডেকে পাঠানো হয়। অভিযান পরিচালনা ও জিম্মিদের উদ্ধার কৌশল নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় জিম্মি উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে কমান্ডো অভিযান চালানো হবে।   পরিকল্পনা অনুযায়ী সিলেটে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কাছে ‘মুভ’ সিগন্যাল পাঠানো হয়। সিগন্যাল পেয়ে ভোর ৪টায় চল্লিশজন কমান্ডোর একটি দল এএন-৩০ বিমানে করে ঢাকায় এসে নামে। তাদের সহায়তার জন্য কৌশলগত অবস্থান (কাট আউট) নেয় ৪৬ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের সদস্যরা। সাঁজোয়া যান নিয়ে অগ্রগামী হয় সাভার ৯ম পদাতিক ডিভিশনের একটি দল। নৌবাহিনীর কমান্ডোরা গুলশান লেকে বিশেষ নৌযান নামায়। আক্রান্ত রেস্টুরেন্ট ভবনের আশপাশে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগানসহ ভারি অস্ত্র বসানো হয়।   এমন রণসজ্জার একপর্যায়ে সকাল ৭টার দিকে মাঠে আসে সেনাবাহিনীর ১১টি এপিসি (আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার), ১৬টি জিপ ও ৩টি পিকআপ ভ্যানসহ বেশ কিছু সাঁজোয়া যান। কিন্তু ভেতরে বেশ কয়েকজন বিদেশী নাগরিক জিম্মি অবস্থায় থাকায় চূড়ান্ত অভিযানের সিদ্ধান্ত বারবার বিলম্বিত করা হয়। সকাল ৭টার দিকে হ্যান্ডমাইকে শেষবারের মতো জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু এবারও জঙ্গিদের তরফ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।   সূত্র জানায়, এটি ছিল ‘ফাইনাল কল’। কিন্তু সাড়া না মেলায় থান্ডারবোল্ট অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। এ পর্যায়ে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরুলের নেতৃত্বে সাঁজোয়া যান নিয়ে সীমানা প্রাচীর ভেঙে ভবনের ভেতর ঢুকে পড়ে কমান্ডোরা। একইসঙ্গে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ শুরু করে র‌্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। গুলি ও গ্রেনেডে প্রকম্পিত হতে থাকে পুরো গুলশান এলাকা। কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর সোয়া ৮টার দিকে আস্তে আস্তে গুলির শব্দ থেমে আসে। ভিন্ন এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারদিকে। সবুজ সংকেত পেয়ে এগোতে থাকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তখন অভিযান সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চিত হন অপারেশন সাকসেসফুল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রথমেই অক্ষত অবস্থায় বেশ কয়েকজন নারী ও শিশুকে বের করে আনেন। এরপর একে একে গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। মাত্র ১৩ মিনিটের এই অভিযানে যৌথবাহিনীর সদস্যরা দুষ্কৃতকারীদের পুরোপুরি নির্মূল করতে সক্ষম হয়। যৌথবহিনীর গুলিতে নিহত হন ৬ অস্ত্রধারী জঙ্গি। ভবনের আর কোথাও কোনো জঙ্গির অবস্থানের তথ্য না পেয়ে আক্রান্ত হোটেলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় কমান্ডোরা। এরপর সাড়ে ৮টার দিকে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।   ঘটনাস্থল থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত চারটি পিস্তল, একটি ফোল্ডেড বাট একে ২২, একটি ওয়াকিটকি সেট, চারটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে। ভবনের চারপাশে কড়া নিরাপত্তা প্রহরা বসানো হয়। অভিযানের সময় প্যারা কমান্ডোদের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ র‌্যাব ও পুলিশের উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাকে। এদের অনেকে গুরুতর আহত হন। র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জঙ্গিদের গ্রেনেডের স্পি­ন্টারে গুরুতর আহত হন। তার দেহে ৪টি স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়। অভিযান শেষে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।-যুগান্তর
৩ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে