বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪১:২০

স্বামী–স্ত্রীর গোপন কথা!

স্বামী–স্ত্রীর গোপন কথা!


সুলতানা আলগিন : সংসারে অনেক সময় কিছু কথা স্বামী গোপন রাখেন। কিছু কথা স্ত্রীও। দীর্ঘদিনের দাম্পত্য জীবন পার হয়েও মনের গভীরের গোপন কথাটি হয়তো জানা হয় না। এই গোপনীয়তা দাম্পত্যের জন্য ভালো নাকি খারাপ?

গোপন কথাটি সব সময় রয় না গোপনে। তা নিয়েই টানাপোড়েন, সংসারে অশান্তি, বিবাদ-কলহ। কাছের সম্পর্কের মধ্যে অতি গোপনীয়তা হলো নীরব বিষ। দীর্ঘদিনের গোপন কোনো বিষয় যখন চলে আসে প্রকাশ্যে, তখন তা নানামুখী জটিলতার সৃষ্টি করে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই, গোপনীয়তার পর্দা একদিন না একদিন সরে যাবেই—আড়াল ভেঙে বেরিয়ে আসবে সত্য।

পরিবারে কত গোপন কথা বা সম্পর্কই না থাকে! স্বামী-স্ত্রী, মা-মেয়ে-ছেলে, ভাইবোনের মধ্যেও নানা রকম গোপনীয়তার দেয়াল থাকে। এই বন্ধনগুলো ছোট হলেও এর জের চলে জীবনভর।

মানবমন বড় রহস্যময়। নারী-পুরুষ সবার জীবনেই কিছু স্মৃতি থাকে একান্ত গোপনীয়। কিছু ইচ্ছা থাকে গোপনীয়। কিছু দুঃস্বপ্ন থাকে গোপনে। ঘটে যাওয়া অতীত কাহিনি গোপন রাখেন অনেকে। এসব জানাজানি হলে প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সেটি ভেবে জানাতে চান না। কারও হয়তো গভীর বাল্যপ্রেমের ঘটনা আছে। বিয়ের পরও স্বামী বা স্ত্রীকে তা বলা হয় না। বছরের পর বছর সেই গুরুভার বয়ে বেড়াতে হয়। এই গোপনীয়তা বয়ে বেড়ানো বড় কষ্টের। বড় উদ্বেগের। প্রেম, পরকীয়া—সম্পর্কগুলো আদিকাল থেকেই সবাই লুকিয়ে-চুরিয়ে চালিয়ে আসছে। এসব নিয়ে ঢাক গুড়গুড় চলতেই থাকে। এটা আমাদের এবারের আলোচ্য বিষয় নয়। এ সম্পর্কের বাইরেও যে কিছু লুকোচুরির সম্পর্ক চলে, তা সবাই মানেন কি? একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন? কী সেই সম্পর্ক, যা অনৈতিক সম্পর্কের চেয়েও জটিল?

স্বামী-স্ত্রী দুজনে এলেন একসঙ্গে। স্বামীর আয়ে সংসার চলে। অনেক দিন তাঁরা বিদেশে ছিলেন। দুই ছেলে মেয়ে। বছর দুয়েক হলো দেশে স্থায়ী হয়েছেন। আর বিদেশে যাবেন না। স্ত্রীর কথা হলো তাঁদের এখন পর্যন্ত নিজস্ব কোনো ফ্ল্যাট নেই। বাচ্চাদের পড়ার খরচ অফিস বহন করে। নিজেদের জন্য কিছু করার তাগিদ দিচ্ছেন স্বামীকে। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই স্বামীর। ভাবখানা যেন স্ত্রী কোনো বিচিত্র আবদার করেছেন। অফিস থেকে এসে পত্রিকা পড়েন। ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বাচ্চা বা স্ত্রীর কোনো রকম খবর নেন না।

অথচ তিনি তাঁর ভগ্নিপতির ব্যবসার সব পুঁজি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে দেশের বাড়িতে দালানকোঠা সবই বানিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি। নিজের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও নেই। আর স্ত্রীর কথা তো বাতিলের খাতায়। সব সম্পত্তি বাবা-মায়ের নামে। যা আইনমতে সব ভাইবোন ভাগ পাবেন। তাহলে এত কষ্ট করে বিদেশে থেকে আমাদের কী লাভ হলো?

চেম্বারে স্ত্রী যখন কথাগুলো বলছিলেন, আমি স্বামীর দিকে তাকালাম। তিনি নিশ্চুপ। জানা গেল, বছরের পর বছর বিষয়গুলো তিনি স্ত্রীর কাছে গোপন রেখেছেন। সন্তানেরা ছোট ছিল। তাদের কিছু জানানোর দরকার মনে করেননি।

অবশেষে যখন জানাজানি হলো, তখন অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। স্ত্রী যেমন সব সত্য জেনে বিষণ্ন, বিপন্ন। সন্তানেরাও বাবার ওপর আস্থাহীনতায় ভুগছে। বেচারা ভদ্রলোকও মনঃপীড়ায় ভীষণ কাতর। তাঁর আয়-উপার্জনে গড়ে তোলা সম্পদ হাতছাড়া। ব্যবসায় তাঁর ভাগ নেই। ভগ্নিপতি যখন নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন, তখন তিনি রীতিমতো মানসিক রোগী।

ফরাসি নাট্যকার জঁ র্যা কিনে (১৬৩৯-১৬৯৯) কয়েক শতক আগেই বলে গেছেন, সংসারে কোনো গোপন ঘটনাই গোপন থাকে না। সময় একদিন সবকিছুর খোলামেলা করে দেয়। তখনই বাধে হুলুস্থুল।

মার্কিন কথক, লেখক, মনোশীলনকারী আইয়ানজা ভ্যানজান্টও সতর্ক করতে বাকি রাখেননি। তাঁর ভাষায় ‘ফ্যামিলি সিক্রেটস’ যত গোপন সিন্দুকে বন্দী করে রাখবেন, কোনো লাভ নেই। একদিন তা ব্যাপক ধংসলীলা চালাবেই।

কিন্তু এসব হুঁশিয়ারি কতটাই বা মানা যায়। ঘর-সংসারে নিবেদিত নারীর বিপদ অনেক সময় দ্বিধারি তলোয়ারের মতো। কোনো কোনো নারী স্বামী ও শ্বশুরবাড়িকে না জানিয়ে বাবার বাড়ির আত্মীয়স্বজনকে গোপনে সহায়তা করে থাকেন। এমন অভিযোগ কম নয় সংসারে। কিন্তু তাতেও কি ঝামেলা কম!

স্বামীকে না জানিয়ে একজন স্ত্রী ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখার জন্য বাবার বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। উৎসব পার্বণের খরচ, স্কুল-কলেজের বেতন সবই তিনি গোপনে মেটাতেন। জামাই বাড়ি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আসে—তাই শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের ছিল ব্যাপক কদর। তাঁকে নানা সময় নিমন্ত্রণ করে আদর-যত্ন করা হতো। কিন্তু একদিন বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন এই গোপন উপকারী নারী। জানা গেল, তাঁর আপন ছোট বোনের সঙ্গে স্বামীর অতি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তাঁরা সবার অজান্তে বিয়েও করতে চলেছেন। নিয়ম অনুযায়ী এমনটা ঘটলে তাঁকে তালাক নিতে হবে। বাবা-মাকে জানিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। তাঁরা জামাই বলতে অজ্ঞান। কিছু শুনতে তাঁরা নারাজ। গোপনীয়তার নানামুখী ঘনঘটা তাঁকে গভীর বিষণ্নতায় ঠেলে দিয়েছে।

এই গোপন গোপন খেলা বড়ই বিব্রতকর। বিপজ্জনকও বটে। এসব ঘটনা বর্তমানকে যেমন তিক্ত ও বিষময় করে তোলে, তেমনি ভবিষ্যৎকে করে তোলে অনিরাপদ। পরম্পরায় ছড়িয়ে পড়ে নীরব সংক্রমণ। সন্তানদেরও ভুগতে হয়। তারা যখন বড় হয়, ওই জটিল মনোকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না অনেকে।

আমার এক ভারতীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধুর কথা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক। তার কথা, সংসার তো কুরুক্ষেত্র নয়। সংসার কূটকচালি শেখার স্কুলও নয়। অথচ আমরা গোপনীয়তার ঘনঘটায় সংসারকে ঘনচক্কর বানিয়ে ফেলছি। নিজেকে ঠকাচ্ছি। সন্তান-পরিবার সবাইকে ঠকাচ্ছি। যে ঘটনা ছিল তিল পরিমাণ, তার ওপর গোপনীয়তার নানা চাদর চাপিয়ে একসময় তাকে তাল বানিয়ে ফেলছি। গোড়াতে তা সবার সঙ্গে কথা বলে হয়তো সহজেই মেটানো যেত, কিন্তু যত দেরি ততই তা দুরারোগ্য ব্যাধি হয়ে উঠছে।

আখেরে গোপন কখনোই থাকে না গোপন। মার্কিন চরিত্র পরামর্শক মাইকেল জোসেফসনের কথা বলি, গোপনীয়তা-বিদ্ধ সম্পর্ক, গোপন কথা শুধু আমাদের অসুখীই করে না। আচরণকে বিষময় করে। বোধকে বিপন্ন করে। জীবনকে শরশয্যা করে।
তাঁর মতে, অতি সহজেই এই ব্যাধি থেকে মুক্তি সম্ভব। তা হলো, গোপনীয়তার বন্দিশালা থেকে মনকে মুক্তি জবানকে মুক্তি।

যা করণীয়
*স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন হবে পরম বিশ্বাসের। বন্ধুত্বপূর্ণ, শেয়ারিং ও কেয়ারিং টাইপের। একসঙ্গে থাকতে গেলে ঠোকাঠুকি লাগবেই। এ জন্য নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, লুকোচুরি খেলা ঠিক নয়।

*সন্তানের দায়িত্ব বাবা-মা দুজনের। ছেলেমেয়ের সঙ্গে আচরণের সমতা রাখতে হবে। কাউকে বেশি ভালোবাসতে গিয়ে পরিবারে অন্য সদস্যদের প্রতি দূরের জনসুলভ আচরণ কাম্য নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সময় নিয়ে আলোচনা করুন সন্তানদের ভালোমন্দ, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে।

*সবার নিজ নিজ ভাইবোন, বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব আছে। এ ক্ষেত্রে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের এ বিষয়ে একমত হওয়াটা জরুরি। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের আয়েই সংসার চলে। ভাবটা এমন, যেহেতু টাকাটা থাকে পুরুষের হাতে, তা দিয়ে তিনি ইচ্ছামতো সংসার চালাবেন। কারও ভালো লাগা মন্দ লাগা গুরুত্ব দেবেন না। এটা ঠিক নয়। এখন নারীর আয়-উপার্জনও যুক্ত হচ্ছে সংসারে।

*কোনো কিছুই গোপন করা ঠিক নয়। সব সদস্যকে ঘিরেই দায়-দায়িত্বের সংসার। কাউকে অবহেলা নয়। আবার অহেতুক অতি গুরুত্বও নয়। যখনই স্বাভাবিক আচরণ থেকে বিচ্যুতি, তখনই গোপনীয়তার আড়ালের বিষয়টি আসে।

*সংসারে নানা দায়িত্ব পালন করবেন নারী পুরুষ। সেটাই স্বাভাবিক। সবকিছু এমনভাবে করা উচিত, যা নিজের কাছে, সংসারের অন্য সদস্যদের জ্ঞাতসারেই হয়।-প্রথমআলো

সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে