মিজানুর রহমান খান: সিরিয়া ও ইরাকে ক্রমাগতভাবে দুর্বল হওয়ার প্রেক্ষাপটে আইএস রমজান মাসে শুধু যে বাংলাদেশেই বড় ধরনের হামলা চালানোর দাবি করেছে তা-ই নয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১২ জুন থেকে শুরু করে রমজান শেষ হওয়া পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা থেকে এশিয়ার দেশে দেশে পরিচালিত হামলায় তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। ঈদের দিনে শোলাকিয়ায় হামলার দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি। যদিও আইজিপি কোনো তদন্তের বরাত ছাড়াই গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকে একই সূত্রে গাঁথা বলেছেন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে আর্টিজান বেকারি হামলা-পরবর্তী নতুন ভিডিওতে ‘পুনঃ পুনঃ আঘাত’ হানার নির্দিষ্ট হুমকি দেওয়া হয়েছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিচ্ছেন যে সামনের দিনগুলোতে আইএস পরিচালিত বা তাদের খেলাফত প্রতিষ্ঠার ‘আদর্শ’ দ্বারা একশ্রেণির মুসলিম তরুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত হয়েও ‘ক্রুসেডার দেশগুলোর স্বার্থে’ আঘাত হানতে পারে। আমাদের সরকার তাই কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত রক্ষাকবচ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা ধরে নিই, দেশে আইএস না থাকার দাবি করাটাকে সরকার একটা কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু এই কৌশল কী সুবিধা দিচ্ছে বা দেবে সেটা মূল্যায়ন করা দরকার। গুলশানের ঘটনার পর অন্তত এটা দাবি করা অসত্য হবে যে অল্প বয়সের জঙ্গিরা নিজেদের আইএস বলে দাবি করেনি বা অন্তত আইএসের কথিত সংবাদ সংস্থা ‘আমাক’ তাদের সংশ্লিষ্টতা বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে আইএস নির্মূল হলে পশ্চিমা বিশ্ব তাতে সামরিক বিজয় দেখবে। কিন্তু তা অবশিষ্ট বিশ্ব, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের জন্য স্বস্তিকর না-ও হতে পারে। কারণ আইএসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা নিজের দেশে ফিরবে বা ফিরতে শুরু করবে। এমনকি আসার সময় তারা সঙ্গী-সাথিও নিয়ে আসতে পারে। ফিলিপাইনে ইতিমধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। সেখানকার একটি প্রদেশ প্রকারান্তরে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেছে। ব্রাসেলস ও ইস্তাম্বুলের সাম্প্রাতিক হামলাকেও অনেক বিশেষজ্ঞ মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের ছড়িয়ে পড়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেন।
উন্নত বিশ্ব থেকেও আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য অনেকে সিরিয়া ও ইরাকে গেছে এবং যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে কারও যাওয়ার বিষয়টিকে কেন আলাদা করে দেখা হবে অথবা উন্নত দেশগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থাও তো সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে অপারগ সরকারের পক্ষে এ ধরনের যুক্তি মূলত দুর্বল ও ভিত্তিহীন। কারণ বাংলাদেশ ও তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো ‘আইএস’ আক্রান্ত মুসলিম বা অমুসলিম দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তর্কবিতর্কে এই সন্ত্রাসকে যুক্ত করা হয়নি। অপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের মধ্যে কোনটি বেগবান, তা চিহ্নিত করতে কখনো বিরাট বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।
অবশ্য মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এমন অনেক দেশ রয়েছে, যারা অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে উন্নত হলেও সুশাসন দেওয়ার সুনাম অর্জন করতে পারেনি। মালয়েশিয়ায় নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যেও সন্দেহভাজন আইএস অনুপ্রবেশ চিহ্নিত হয়েছে। এসব থেকে আমাদের ভয় পাওয়া অমূলক হবে না।
বাংলাদেশকে তাই প্রস্তুতি নিতে হবে। আইএস সিরিয়া ও ইরাক থেকে উচ্ছেদ বা নির্মূল হলেও জঙ্গিবাদের বিপদ উবে যাবে না বরং তা ভিন্নরূপে আরও বাড়তে পারে। ৬৪ জেলায় বোমা হামলা চালানোর সময় আইএসের মতো কোনো নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক মুরব্বি জেএমবির লাগেনি।
জেএমবিকে নিষিদ্ধ করার বহু বছর পরে আইজিপি এখন নিজেই তাদের সক্রিয় থাকার সাক্ষ্য দিচ্ছেন। আল-কায়েদা ‘নিশ্চিহ্ন’ ও বিন লাদেনকে নিধন করা হলো। কিন্তু আল–কায়েদা টিকে আছে। উপরন্তু, সিঙ্গাপুরে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গিদের বিরাট উপস্থিতি, যা কিছুদিন আগে উদ্ঘাটিত হলো, সেটা প্রমাণ দেয় যে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের একটি যোগসূত্র গড়ে ওঠা অবাস্তব কোনো বিষয় নয়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় কিছু সন্দেহভাজন বাংলাদেশির উপস্থিতির তথ্যও আমাদের গোয়েন্দাদের হাতে আছে।
সুতরাং ‘কাতিবা নুসান্তারা’ নামের আইএস সহযোগী একটি সংগঠনের সম্ভাব্য প্রভাবও মনের কোণে রাখতে হবে। এটি হলো আইসিসের অধীনে মালয়ভাষীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সিরিয়াভিত্তিক একটি জিহাদি নেটওয়ার্ক। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের জিহাদিরা এর সঙ্গে জড়িত। ৮ জুলাই সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকায় বলবীর সিং লিখেছেন, ‘কাতিবা নুসান্তারা গত মে মাসে তাদের একটি ভিডিওতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’ তাঁর মতে, ‘আইএস যদি নিস্তেজ হয়, তাহলেই সেটা সুখবর নয়। আশির দশকের আফগান মুজাহিদদের মতোই তারা প্রভাব ছড়াবে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি যা উগ্রবাদ চাষের জন্য সহায়ক, তা সহজে বদলাবে না। এমনকি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে আল-কায়েদা ও আইএস একীভূত হতে পারে।’ এ দুই শক্তি একত্রিত হলে তা উপমহাদেশকে আরও বিপদাপন্ন করবে।
আর তাই বাংলাদেশকে সর্বাগ্রে তার মুষড়ে থাকা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবনে চিন্তাভাবনা করতে হবে। খোলা মনে ক্ষমতাসীন দলকে স্বীকার করতে হবে যে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইরা ৬৪ জেলায় বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটিয়ে যে বীজ বপন করেছিলেন, তা ধীরে ধীরে মহিরুহে রূপ নিচ্ছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের ক্ষমতায় যাওয়া থামানো গেছে, কিন্তু মানতে হবে, যে কারণে মানুষ একদা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল, তার ভিত্তিটা দুমড়ে গেছে। বিএনপি আমলের বাংলা ভাইদের ভাবশিষ্যরা আওয়ামী লীগ আমলে ইংরেজি পড়ুয়া শিষ্য হিসেবে ফিরে এসেছে।
সাধারণ মানুষ একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল, সেটা এখন আরও বেশি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। তাই দ্রুত বাংলাদেশকে একটি অধিকতর অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।
এখন যা আশু করণীয়, তার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার সংস্কারে হাত দেওয়া নিশ্চয় সব থেকে কাঙ্ক্ষিত, যা বর্তমান সরকার অবিশ্বাস্যভাবে অগ্রাধিকারের তালিকার বাইরে রেখে চলছে। উচ্চবিত্তের বিপথগামী সন্তানেরা কিন্তু পুরোপুরি ‘আইএস-কায়েদা’ অনুসরণ করেছে। তবে ধর্মীয় শিক্ষার গলদ বা কোনো একটি কারণকেই প্রধানত দায়ী করা সরলীকরণ, কিন্তু আমরা যেন ভাবতে না বসি, বরেণ্য আলেম-ওলামাদের পরামর্শসাপেক্ষ ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকের যথাযথ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে আরও জোর দিতে হবে না!
একটা মস্ত পরিহাস হলো, উদীচী, রমনার বটমূল ও ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলার পরে যেসব পরিচিত মুখকে আমরা ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কারে উচ্চকিত হতে দেখছিলাম, তারা বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদ আলোকিত করলেও সে বিষয়ে এখন আর তাদের কোনো উদ্বেগ জানা যায় না।
বিএনপির প্রতি এত দিনকার কঠোর নীতি সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিশ্চয় কার্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু ১/৭-এর পর কি ভাবতে হবে নাকি হবে না, ওই নীতি আসলে কিসের বিনিময়ে কতটা কী কার্যকর হচ্ছে? মনে হয় নতুন করে হিসাবে বসা উচিত। দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিধ্বস্ত হওয়ার আরও কী নেতিবাচক প্রভাব সামনে পড়তে পারে, সেটা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। এত কিছুর পরেও ইউপি নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে বিএনপিই আওয়ামী লীগের নিকটতম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি এটা মুছে দিতেই হয়, তাহলে সরকারকেই একটা গ্রহণযোগ্য বিরোধী দল সৃষ্টি করে দিতে হবে! শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া উগ্রবাদের আরও উত্থান, আরও বিস্তৃতির যে আশঙ্কা, তাকে নাকচ করা যাবে না।
ইউপি নির্বাচনে ১২৯ হত্যাকাণ্ড এবং ঘাতকদের দায়মুক্তি ভোগকেও উগ্রবাদের পৃষ্ঠপোষকতা হিসেবে দেখতে হবে। অথচ ‘বিএনপি-জামায়াত’ এ সংক্রান্ত গোটা প্রক্রিয়ায় দৃশ্যত অপাঙ্ক্তেয়। আমরা একই সঙ্গে স্মরণে আনব, বিরোধী দলের ভূমিকার কারণেই রাজশাহীতে নাগরিক সংবর্ধনা থামিয়ে বাংলা ভাইদের সেদিন গ্রেপ্তার ও দ্রুত বিচারের নজির স্থাপন করতে উগ্রবাদ দমনে সেদিনের উদাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকার বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশের সামনে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হলো ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় রেডিক্যালাইজেশন নিয়ন্ত্রণ করা। আরও দেরি হওয়ার আগেই স্বীকার করা ভালো, উন্নত বিশ্বে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীদের আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ, আরও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি নিশ্চিত করা হলেই গুলশান বা শোলাকিয়ার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে তেমন ভরসা আমাদের কেউ দিচ্ছে না। দলীয় অনুগ্রহভাজনদের সরিয়ে জনপ্রশাসনের সব উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত কর্মীর পদায়ন অবশ্যই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু তারা যাতে পেশাদারিত্ব দেখাতে পারে, সে জন্য একটি অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ লাগবে। উগ্রবাদের বিস্তার রোধ বা জঙ্গি দমন এবং ক্ষমতার বৈধ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোকাবিলা এ দুইয়ের মধ্যে যে সুস্পষ্ট এবং অত্যন্ত মৌলিক পার্থক্য আছে, সেটা দেশের মানুষকে যেমন, তেমনি বিশ্বকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখাতে হবে। রক্তাক্ত হলি আর্টিজানের শোক প্রকৃত শক্তি হবে, যদি ক্ষমতাসীনেরা এই পাঠ নিতে পারে।-প্রথম আলো
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
১৩ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ