বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:৫৩:০৩

টার্গেট ‘অন্য ধর্মে’ বিশ্বাসী বিদেশিরা

টার্গেট ‘অন্য ধর্মে’ বিশ্বাসী বিদেশিরা

নিউজ ডেস্ক : গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ওকিচেন রেস্টুরেন্ট ও হলি আর্টিসান বেকারিতে সবচেয়ে বেশি যেতেন ইতালীয়রা। এর পরই আছেন স্প্যানিশ, জাপান ও ফ্রান্সের নাগরিক। যে নয় ইতালীয় নিহত হন, তারা সবাই ওই রেস্তোরাঁয় প্রায়ই যেতেন। ঘটনার দিন তারা আগেই বুকিং দিয়ে ওকিচেনে যান।

নিহত সাত জাপানি একই মালিকের আরেকটি রেস্তোরাঁয় নিয়মিত অতিথি ছিলেন। গুলশানের ১১৯ নম্বর সড়কে ইজমি নামের ওই জাপানি খাবারের রেস্টুরেন্টের অবস্থান। তবে স্প্যানিশ খাবারের স্বাদ নিতে ১ জুলাই তারাও ওকিচেনে যান আগে থেকে বুকিং দিয়ে।

রেস্তোরাঁটিতে অনেক দেশের নাগরিকই যেতেন। ঘটনাক্রমে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন নিহতরা। ইতালি, জাপানিসহ সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের নাগরিক জঙ্গিদের টার্গেট ছিল না; তাদের টার্গেট ছিল ইসলামের পরিবর্তে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বিদেশিরা।

সূত্রমতে, হামলাকারীদের তিনজন ঘটনার আগে তিনবার ঘটনাস্থল রেকি করে। নিবরাস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজ ওই রেস্তোরাঁয় আগেও গেছে। ফলে তাদের কাছে তথ্য ছিল, সেখানে বিদেশিদের পাওয়া যাবে।

উদ্ধারকৃতদের তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা গেছে, ঘটনার দিন রেস্তোরাঁয় পাঁচ জঙ্গিই ঢুকেছিল। তাদের মধ্যে নিবরাস, রোহান ও মীর সামিহ মোবাশ্বের গুলি ছোড়ে আর খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। রেস্তোরাঁর শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিমের হাতেও অস্ত্র তুলে দেয় জঙ্গিরা।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনাস্থল থেকে জঙ্গিদের কোনো মোবাইল ফোন উদ্ধার করা যায়নি। তারা জিম্মিদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড নিয়ে হত্যার ছবি পাঠায়। হলি আর্টিজান বেকারির প্রবেশমুখে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। তবে অভিযানের সময় ওই ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানকার ফুটেজ মেলেনি। পাশের চারটি বাড়ির সামনের সিসিটিভি ফুটেজে কিছু দৃশ্য ধরা পড়ে। হামলার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল আরও পাঁচ-ছয়জনের একটি দল। তাদের তিনজনকে ফুটেজে দেখা গেছে।

তথ্য মিলেছে, সহযোগীসহ হামলাকারীরা মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থলে আসে। মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে বলে জানিয়েছে সূত্র।

আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেডের সেইফটি পিন, ছোরা, চাপাতিসহ ৭৪ রকমের আলামত ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করেছে পুলিশ। এসব আলামত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হচ্ছে।

সোমবার নিহত পাঁচ জঙ্গির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তদন্তকারীদের অনুমতি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) এক কর্মকর্তা  বলেন, ‘গুলশান হামলায় দুই দেশেরই ১৬ জন নিহত হয়েছেন। খুনিরা আগে রেস্তোরাঁটিতে রেকি করে খোঁজ-খবর নিয়েছে। ফলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানার চেষ্টা করেছি, ইতালীয় ও জাপানিরাই জঙ্গিদের টার্গেট কি না। তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে তা নয়, জঙ্গিদের টার্গেট ছিল কয়েকজন বিদেশিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা ও এ খবর প্রচার করা।’

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, হলি আর্টিমানে কয়েকটি দেশের নাগরিক যেতেন। তাদের মধ্যে ইতালির নাগরিকদের সংখ্যা বেশি ছিল। ঘটনাক্রমে জাপানিরাও আক্রান্ত হন।   

অভিযানের সময় ও আগে উদ্ধার করা ৩২ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন তদন্তকারীরা। ঘটনাস্থলের বাইরের চারটিসহ প্রায় অর্ধশত সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এতে জানা গেছে, জঙ্গিরা টেনিস ব্যাটের ব্যাগে ভরে রাইফেলসহ অস্ত্র নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোকে। নিচ তলায় বাধার মুখে পরেই আল্লাহু আকবার বলে গুলি চালায় তারা। জঙ্গিরা সেখানে নিজস্ব মোবাইল ফোন নিয়ে যায়নি। তারা রেস্তোরাঁর কর্মীদের কাছ থেকে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড জেনে জিম্মিদের ফোন ব্যবহার করে হত্যার ছবি পাঠায়। তারা বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলে হত্যার খবর বাইরে জানায়।

হামলার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল আরো পাঁচ-ছয়জনের একটি দল। তাদের তিনজনকে ফুটেজে দেখা গেছে।

রেস্তোরাঁর একজন কর্মকর্তা পরিচয় না লেখার শর্তে বলেন, হলি আর্টিসান বেকারি রাত ৯টার দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আর রাত ১০টার পরও খোলা থাকে ওকিচেন। সেখানে স্প্যানিশ খাবার পরিবেশন করা হলেও প্রায় সব দেশের লোকজনই যেতেন। কাছাকাছি দূতাবাস হওয়ায় ইতালির নাগরিকরাই বেশি যেতেন ওকিচেনে। সেখানে একজন ইতালিয়ান শেফও ছিলেন। এ ছাড়া আর্জেন্টাইন দুজন শেফ ছিলেন, যারা স্প্যানিশ ভাষা জানেন। তারাও ইতালিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। এ কারণে ইতালিয়ানদের বেশি পছন্দ ছিল ওকিচেন।

ওই কর্মী আরো জানান, রেস্তোরাঁটির মালিক সাদাত মেহেদীর গুলশানের ১১৯ নম্বর সড়কে ইজমি নামে জাপানি খাবারের আরেকটি রেস্তোরাঁ আছে। নিহত সাত জাপানি সাধারণত সেখানেই যেতেন। কিন্তু ঘটনার দিন তারা টেবিল রিজার্ভ করে স্প্যানিশ খাবারের স্বাদ নিতে ওকিচেনে যান।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার দুইদিন আগে  তিনজন ওই রেস্তোরাঁয় তিনবার রেকি করেছিল। তাদের মধ্যে নিবরাস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজ ছিল। ফলে হামলাকারীরা জানত ওই রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন বিদেশি অতিথির সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ জন থাকে। তবে ঘটনার দিন শুক্রবার হওয়ায় উপস্থিতি কম ছিল।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব বিদেশিদের হত্যা করে খবর প্রচার করা। এ কারণে তারা শেফসহ পাঁচ বিদেশিকে শনাক্তই করতে পারেনি। জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা জিম্মিদের দেশ সম্পর্কে জানতে চায়নি। শুধু ভিন্নধর্মী এবং বিদেশি কি না তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে।
 
আরেকটি সূত্র জানায়, হামলাকারীরা বনানীর একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল বলে তথ্য পাওয়ার পর সেখানে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। তবে ওই খবরের সত্যতা মেলেনি। সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণ করে আসা এবং নিখোঁজ থাকা যুবকদের তথ্য সংগ্রহ করে হামলাকারী চক্রটিকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা আলামতগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সহায়তা নেয়া শুরু হয়েছে।

উদ্ধার হওয়া শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিম ও তরুণ তাহমিদ হাসিব খানকে গতকাল পর্যন্ত ফেরত পায়নি তাদের পরিবার। স্বজনরা বলছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হাসনাত দাবি করেন, জিম্মি অবস্থায় প্রাণভয়ে তিনি জঙ্গিদের সহায়তা করেন, হাতে অস্ত্রও তুলে নেন। তার বাবা এম রেজাউল করিম বলেন, মেয়ের জন্মদিনে খেতে যাওয়ার জন্য হাসনাতও ওকিচেনে টেবিল রিজার্ভ করেছিলেন।

ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করে দক্ষ অফিসার দিয়ে গুলশানের ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজন হলে আমরা বাইরের সহায়তা নেব।’

গত ১ জুলাই রাতে গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডে ওকিচেন এবং হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গিরা ২০ জনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে জাপানি সাতজন, ইতালির নয়জন এবং একজন ভারতীয়। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে মারা গেছেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ অভিযানে মারা যায় সন্ত্রাসীরা। -বাংলামেইল
১৩ জুলািই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে